আদায় না হওয়া ঋণে চাপ বাড়ছে, দুরবস্থায় ব্যাংক খাত

ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ। যা লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এই খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ। বিদায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ শতাংশ। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এসব ঋণের বেশির ভাগই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। কারণ, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যা তাদের নিট আয়ে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। শুধু তাই নয়, মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। মন্দ ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে ছাড় দেওয়া এবং সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এই প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঋণগুলো দেওয়ার সময়েই যথাযথ নিয়ম মেনে দেওয়া হয়নি। যে খাত দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেখানে না যাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। এই বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এই বিষয়ে আরও বেশি নজরদারি বাড়ানো। তিনি বলেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ওই ব্যাংকের জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের দুই ধরনের ক্ষতি হয়।

একটি হচ্ছে- ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা পরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, এ মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এটা করতে গিয়ে সরাসরি চাপ পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার সময় যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় রাখলে এ ঋণের পরিমাণ এমন হারে বাড়ত না।’
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি ধাপ রয়েছে। খেলাপি হওয়ার পর তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত নিম্নমান, ছয় থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি সময় খেলাপি থাকলে তা মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে এ পর্যন্ত মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৪ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, মন্দমানের খেলাপি ঋণের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণই রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বা ৯১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের, ৬২ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয়তে অগ্রণী ব্যাংক, মন্দঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর পরে সোনালী ব্যাংকে ১৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংকের ১৩ হাজার ৪০৭ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৪৯০ কোটি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৮৮৩ কোটি টাকার মন্দ ঋণ রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযাযী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও বাড়ছে মন্দমানের খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।

এদিকে, অস্বাভাবিক হারে মন্দ ঋণ বৃদ্ধিতে ব্যাংক খাতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে অন্তত ১৩টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে কয়েকটি ব্যাংকের প্রভিশন উদ্বৃত্ত থাকায় ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে এই পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এ সময়ে সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। 

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
এশিয়া কাপে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের বদলে বেজে উঠে আইটেম সং Sep 15, 2025
img

জামায়াত নেতা আযাদ

মুক্তিযুদ্ধ না মানলে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা হবে Sep 15, 2025
img
দেশে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিভক্তির রাজনীতি চলছে : মাসুদ কামাল Sep 15, 2025
img
নারায়ণগঞ্জে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারাল ১ Sep 15, 2025
img
গত ১৭ বছর কোনো কাজ করতে পারিনি : বেবী নাজনীন Sep 15, 2025
img
ম্যাচ শেষে হ্যান্ডশেক না করার কারণ জানালেন সূর্যকুমার Sep 15, 2025
img
বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে সনদ বাস্তবায়নে আদালতের মত চায় বিএনপি Sep 15, 2025
img
জাপানে ১০০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ Sep 15, 2025
img
জুলাই সনদ না মানলে প্রার্থিতা বাতিলের প্রস্তাব জামায়াতের Sep 15, 2025
img
দেশের শান্তি বড় শান্তি : প্রধান উপদেষ্টা Sep 15, 2025
img

কাতারের প্রধানমন্ত্রী

দ্বৈত নীতি বন্ধ করে ইসরায়েলকে শাস্তি দিন Sep 15, 2025
img
হেসে খেলেই পাকিস্তানকে হারাল ভারত Sep 14, 2025
img
লুৎফুজ্জামান বাবরকে স্যার স্যার করে জড়িয়ে ধরলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Sep 14, 2025
img

পাপিয়া

আমরা কি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা! Sep 14, 2025
img
সিলেটের ডিসি সারওয়ার আলমকে শোকজ Sep 14, 2025
img
পড়ার সুযোগ পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছেন না হাজার হাজার শিক্ষার্থী Sep 14, 2025
img
দীর্ঘ নয় বছর পর শিবচরে কমিটি ঘোষণা করলো বিএনপি Sep 14, 2025
ব্যাপক অভিযানে সৌদিতে গ্রেপ্তার ২১ হাজারেরও বেশি প্রবাসী Sep 14, 2025
img
৬ বিভাগে ভারি বর্ষণের সতর্কতা জারি, পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ধসের শঙ্কা Sep 14, 2025
img
নাইজেরিয়ায় বিয়ের বাস নদীতে পড়ে প্রাণ গেল ১৯ জনের Sep 14, 2025