চীনের জন্য পাতা ফাঁদে শিকার এখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই?

টেক্সাসের হিউস্টনের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ওয়েন জানান, শুল্ক কীভাবে তার ও তার পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলবে, সেটা তাকে বোঝাতে কোনও অর্থনীতিবিদের দরকার নেই। তিনি বলেন, তথাকথিত লিবারেশন ডে’র পর মাত্র দুদিনে আমাদের বিনিয়োগের বিশাল অংশ হারিয়েছি, যার মধ্যে ছিল অবসর তহবিলও। লিবারেশন ডে’কে উপহাস করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, বলতে পারেন আমার সম্পদের একটা অংশ এখন আমার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে চলে গেছে।

ওয়েন আরও জানান, মঙ্গলবারের শেষে তার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ ডলারে। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২ এপ্রিলের ঘোষণার পরই মার্কিন স্টক মার্কেট ধস নামে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক কমে ১০.৫৩ শতাংশ, নাসডাক প্রবেশ করে বেয়ার মার্কেটে।

ওয়েন বলেন, ‘আমরা কয়েক বছরের মধ্যে স্বচ্ছন্দে অবসরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, এখন সেটা অনিশ্চিত। শুধু স্টক মার্কেটের ক্ষতির কথাই নয়, বরং অস্থির এক ভবিষ্যতের দিকেও যাচ্ছি।

২০০০ সালের ইন্টারনেট বাবল ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা পেরিয়ে এসেও তিনি এখন নতুন করে শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘এই অর্থনৈতিক ধস রাজনীতির কারণে তৈরি।বাজারের উত্থান পতন বা অর্থনৈতিক নয়।’

অন্যদিকে, হিউস্টনের ক্যাফে মালিক ক্যাথি জানান, কফি বিনের দাম ফেব্রুয়ারিতেই বেড়েছিল। ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, প্রতিপাউন্ড কফির দাম ২০ থেকে ২৭ ডলার পর্যন্ত বাড়াতে হতে পারে। শুল্কের কারণে এখন প্রত্যেক আমেরিকানকে প্রতি কাপ কফির জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক, জুতা, গৃহস্থালি সামগ্রীসহ আরও অনেক কিছুর দাম বাড়বে।

ই-কমার্স লজিস্টিক কোম্পানি এসটিএ ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লাই চেইনের প্রেসিডেন্ট ফেং ইয়ে বলেন, ‘বিক্রেতাদের খরচ বাড়লে, সেই বোঝা সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়বে।’
অন্য এক ঠিকাদার বলেন, ‘আমি তিনবার ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছি, কিন্তু এই শুল্ক আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। উচ্চমূল্যের বাসাবাড়ির কাজগুলো হারাচ্ছি, কারণ মক্কেলরা শেয়ারবাজারে ক্ষতির মুখে পড়েছে।’

ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাপিটাল লাম্বার কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক মার্ক সারাকো জানান, শুল্কের কারণে প্রতি বাড়ির খরচ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ার আগুনে পুড়ে যাওয়া ১৫ হাজার ঘরের পুনর্নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাবে প্রায় ৬০ কোটি ডলার।

সম্পত্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোটালিটির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন বাড়ি নির্মাণে গড় খরচ ১৭ হাজার থেকে ২২ হাজার ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

কোটালিটির নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার ক্যারল বলেন, ‘এই শুল্ক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।’

টেক্সাস ও ক্যালিফোর্নিয়ায় ব্যাটারি কারখানার মালিক ড্যানিয়েল ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ব্যাটারি নিয়ে। তিনি মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তিনি বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশে সব ব্যাটারি তৈরি করতে চায়, তবে কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল চীন থেকেই আনতে হবে, কারণ আমাদের সেই প্রযুক্তি এখনও যুক্তরাষ্ট্রে নেই। ড্যানিয়েলের মতে, ব্যাটারি প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদ্যুতিক যানবাহনে ব্যবহৃত অধিকাংশ ব্যাটারিই চীন থেকে আসে, কারণ সেই উৎপাদন সক্ষমতা অন্য দেশের নেই। ড্রোন, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, গবেষণাগার ও উচ্চ প্রযুক্তির পণ্যে ব্যবহৃত ব্যাটারিরও একটি বড় অংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়।

ড্যানিয়েল বলেন, ‘যদি চীন তাদের উন্নত ব্যাটারি রফতানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা, হাসপাতাল ও উৎপাদন খাত বড় সমস্যায় পড়বে।’

তিনি জানান, ব্যাটারির পুরো উৎপাদন শৃঙ্খল গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত পাঁচ বছর লাগবে, কারণ কাঁচামাল ও প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে। ড্যানিয়েলের অভিযোগ, শুল্ক আরোপের আগে কোনও আলোচনা হয়নি, প্রস্তুতির সময়ও দেওয়া হয়নি। নির্দেশনা অস্পষ্ট, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী।

এই অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি কেবল পুরোনো কিছু ক্রেতাকে সীমিতভাবে পণ্য সরবরাহ করছেন। রোলস-রয়েসের বিদ্যুৎপ্রদানকারী ব্র্যান্ড এমটিইউ ইতোমধ্যে শুল্কজনিত খরচ অনিশ্চয়তার কারণে মূল্য নির্ধারণ বন্ধ করেছে।

ড্যানিয়েল বললেন, ‘বহু প্রতিষ্ঠান এখন দাম বলতে পারছে না, অর্ডার নিতে পারছে না, পণ্য পাঠাতে পারছে না। এর ফলে পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নির্বাচন অবশ্যই হবে, তার আগে বিচার ও সংস্কার দৃশ্যমান হতে হবে : আখতার হোসেন Apr 19, 2025
img
ট্রাম্প-মোদি-শি এসে সমস্যার সমাধান করবে না: মির্জা ফখরুল Apr 19, 2025
img
বাংলাদেশ ১৭৯ রানের সহজ লক্ষ্য দিলো পাকিস্তানকে Apr 19, 2025
img
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পখাতের জন্য আত্মঘাতী হবে Apr 19, 2025
img
শেখ হাসিনা-কাদের-আসাদুজ্জামানসহ ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা Apr 19, 2025
img
আরসিবির হারে ক্ষুব্ধ বীরু: ‘কমন সেন্স দেখাতে পারলেন না বিরাটরা’ Apr 19, 2025
img
‘মায়ায় জড়ানো এক নাম তা হলো তুমি’, অনন্তর জন্মদিনে বর্ষা Apr 19, 2025
img
হান্নান মাসউদ জানালেন, ছবির সেই অফিসটির মালিক কে Apr 19, 2025
img
‘বরবাদ’-এর প্রযোজকের অভিযোগ: হল মালিকরা দিচ্ছেন না আয়ের সঠিক হিসাব Apr 19, 2025
img
ডিপিএলে বিতর্কিত আউট ঘিরে তদন্ত, বিসিবি সভাপতির সতর্ক বার্তা Apr 19, 2025