সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কে ড. ইউনূসের বক্তব্যে এদেশের মানুষ খুশি হয়েছে: ফরহাদ মজহার

খ্যাতিমান লেখক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশী কর্পোরেট বিনিয়োগের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও একে নিঃশর্তভাবে ইতিবাচক বলা ভুল হবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনার পাশাপাশি এর ঝুঁকি ও নেতিবাচক দিকগুলোও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে ফরহাদ মজহার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সফল ‘ইনভেস্টমেন্ট সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তিনি চিন সফরে গিয়ে বাংলাদেশের ভূগোল ও কৌশলগত অবস্থান তুলে ধরে চিনা বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ নোনা দরিয়ার গার্ডিয়ান”—এই দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে ড. ইউনূস আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযোগের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আহ্বান জানিয়েছেন, যা দিল্লির প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।

ফরহাদ মজহার মনে করেন, এই বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের মাঝে নতুন আশা জাগিয়েছে, বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্স ও বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তার প্রেক্ষাপটে। তবে তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করেছেন, কর্পোরেট বিনিয়োগের ইতিবাচক দিক যেমন—কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা—তেমনই এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে, যেমন পুঁজি প্রত্যাহার, পরিবেশগত ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে হুমকি।

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক পুঁজির দেশে অবাধ বিদেশী বিনিয়োগ যদি শক্ত রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি ছাড়া হয়, তাহলে তা লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর স্বর্গে পরিণত হতে পারে।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যারা অতীতে বাংলাদেশকে অর্থপাচার ও লুটপাটের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তারাই আবার নতুন বিনিয়োগের নামে ফিরে আসতে পারে।

বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক অর্থনীতিগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে ফরহাদ মজহার উল্লেখ করেন, পুঁজিকে ভোক্তাভিত্তিক ব্যবস্থার বাইরে এনে উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে রূপান্তর করা সহজ নয়। তিনি বলেন, “ড. ইউনূস কুকুরের লেজ ধরে কুকুরকে পোষ মানাতে চাইছেন, কিন্তু উল্টো কুকুর কামড়ে দিতে পারে।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক পুঁজির বিচলনকে সঠিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত কাঠামোর মধ্যে আনাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে তিনি একটি গণমুখী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, যা বৈষম্য কমাবে এবং দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

ফরহাদ মজহার বলেন, “আমরা যদি কেবল কর্পোরেট বিনিয়োগের নামে সস্তা শ্রম ও নিপীড়নের ভিত্তিতে অর্থনীতি এগিয়ে নিতে চাই, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে কালসাপে পরিণত হতে পারে।” তিনি উল্লেখ করেন, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন ভিত্তিক বিনিয়োগ নীতি বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিপীড়নমূলক অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে।

তিনি আরও বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেলকে পরিবর্তন করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গতিশীল ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া।” ড. ইউনূসের সদিচ্ছা ও আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বপ্নের প্রশংসা করলেও ফরহাদ মজহার মনে করেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরে যদি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসে, তবে বিদেশী বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে কর্পোরেট শক্তির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন, “সাসকিয়া সাসেন যেমন ‘Expulsions’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, তেমনি কর্পোরেট প্রভাব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ফেলে।”

তিনি সতর্ক করে বলেন, “বঙ্গোপসাগরের গার্ডিয়ান হতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তা হতে হবে গভীর, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক। একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বৈশ্বিক পুঁজির বাস্তবতা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”

ফরহাদ মজহারের মতে, বাংলাদেশে বিদেশী কর্পোরেট বিনিয়োগ একটি জটিল বাস্তবতা— যা সম্ভাবনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক ঝুঁকি বহন করে। তাই নীতিনির্ধারণে আবেগ নয়, প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি।

এফপি/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুলাই যোদ্ধাদের সনদ দেওয়া সম্ভব কিন্তু একটু ক‌ঠিন : উপদেষ্টা শারমীন Jul 04, 2025
img
অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় উন্মাদনা ছড়াচ্ছে ‘ওয়ার ২: প্রথম শো ভোর পাঁচটায় Jul 04, 2025
img
ভারতের আধিপত্য রুখতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে : আব্দুস সালাম Jul 04, 2025
img
মন্দোদরী চরিত্রে পা রাখছেন কাজল? Jul 04, 2025
img
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও 'কঙ্গুভা ২' -এর দাবি ফ্যানদের Jul 04, 2025
img
যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে লেবাননে ফের হামলা চালাল ইসরায়েল Jul 04, 2025
img
পাকিস্তানের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সাবেক কোচ Jul 04, 2025
img
চুয়াডাঙ্গায় ট্রাক চাপায় নিহত ৩ Jul 04, 2025
img
‘আখণ্ড ২’তে কেন্দ্রীয় চরিত্রে বজরঙ্গি’র মুন্নি Jul 04, 2025
img
সিরিজে ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের: জয়সুরিয়া Jul 04, 2025
img
রাবণ কি ফিরছেন আধুনিক রূপে: আল্লু অর্জুন-প্রশান্ত নীলের ‘রাবণম’ ঘিরে রহস্য Jul 04, 2025
img
পাকিস্তান চীনের ‘জীবন্ত পরীক্ষাগার’, দাবি ভারতের Jul 04, 2025
img
কপিলকে ছুঁয়ে ধোনির পথে এগোচ্ছেন জাদেজা Jul 04, 2025
'জুলাইয়ের বিচারের আগে নির্বাচন হতে দেব না' Jul 04, 2025
গাজীপুরে বিএনপির সমাবেশ থেকে কি বার্তা দিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ? Jul 04, 2025
img
টানা তিন হিট, এক ক্যামিও: বলিউডে নির্ভরতার নাম অক্ষয় কুমার Jul 04, 2025
img
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শান্তি নাই: সামান্তা শারমিন Jul 04, 2025
img
করণ জোহরের ফ্যান্টাসি থ্রিলারে রাজকুমার রাও Jul 04, 2025
img
টাকা মেরে খাওয়ার জন্য আমরা ক্ষমতায় বসিনি : ধর্ম উপদেষ্টা Jul 04, 2025
img
আমির খান, জাভেদ আখতার কি মারাঠি বলেন?প্রশ্ন নীতেশ রানের Jul 04, 2025