কথা মতো জামিন না দিলে বিচারককে বান্দরবানে পাঠিয়ে দিতো: শিশির মনির

অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে। প্রথম দিনের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
 
বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। আদালতে রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

আদালত থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যতদিন সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ থাকবে, ততদিন স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় এবং পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে বাধা থাকবে। এটা চ্যালেঞ্জ করেছি। প্রধান বিচারপতির গঠন করা বিশেষ বেঞ্চে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেছি। আমরা অরিজিনাল সংবিধানের বিধান প্রতিস্থাপন চেয়েছি, যেখানে সবকিছু সুপ্রিম কোর্টের ওপর ছিল। অতি দ্রুত পৃথক সচিবালয় চেয়েছি।
 
‘কারণ নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সবকিছু আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত আছে। আপনারা দেখেছেন গভীর রাতে আদালত বসে সাজা দেওয়া, একদিনে ১৭ জন সাক্ষী নেওয়া কিংবা গোপন জায়গা থেকে আদেশ আসা। এসব কিছুর মূলে থাকে আইন মন্ত্রণালয়ের খবরদারি। এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের খবরদারি থেকে তাদের (নিম্ন আদালতের বিচারকদের) যদি স্বাধীন করে দেওয়া যায়, তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে পারবে। নিম্ন আদালতে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে।’

শিশির মনির আরও বলেন, আজকে কোর্ট বলেছে—এসব বিষয়ে পৃথিবীর অন্য দেশে পৃথক সচিবালয় আছে কি না, তার উদাহরণ দিতে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার বিষয়ে গবেষণা করতে বলেছে। ওইসব দেশে কীভাবে পৃথক সচিবালয় ব্যবস্থাপনা করা হয়, কেমন সচিবালয় হবে, তাও যেন উপস্থাপন করতে বলেছে। আমরা আশা করি আগামীকাল এটি উপস্থাপন করতে পারবো।
 
এক প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, "আমি বলতে চেয়েছি- জামিন দিতে বলেছে, জামিন দেয়নি, তাই বান্দরবানে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাজা দিতে বলছে, সাজা দেয়নি, তাই ঢাকা থেকে মফস্বল এলাকায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এটা একটা থ্রেট। এটা কে দিয়েছে? তৎকালীন আইন মন্ত্রণালয়। কারণ তারা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। কথা না শুনলে তো বদলি করবে। কথা না শুনলে বান্দরবান-সুন্দরবন পাঠাবে। আমি বলেছি, এগুলো অপব্যবহার হয়েছে। এসব কারণে নিম্ন আদালতের বিচারকরা খুব লজ্জাবোধ করেন। নিজেদের ছোট মনে করেন। স্বাধীনতা না থাকলে তো কাজ করা যায় না।"

এর আগে গত বছরের ২৭ অক্টোবর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। তাই রুল শুনানিতে নতুন বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

গত বছরের ২৫ আগস্ট সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, ২০১৭ সালের জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিটটি করেন। আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ–সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, রুলে তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে হাইকোর্ট। আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তা প্রয়োগ করে থাকেন।

রিট আবেদনকারী সাত আইনজীবী হলেন মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল ও জায়েদ বিন আমজাদ।

রিটকারীদের আইনজীবীর মতে, ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত রয়েছে। একই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। মূলত রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপ দেখা যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের এ দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এবং ‘সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে’ শব্দগুলো সন্নিবেশিত করা হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী আইন অসাংবিধানিক মর্মে ঘোষণা করলে পঞ্চদশ সংশোধন আইন, ২০১১ এর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদের বর্তমান একই বিধানটি প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে এ বিধানটিই বিদ্যমান রয়েছে।

এমআর/টিএ


Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন ছাড়ালো ১ লাখ Dec 01, 2025
img
শেখ সালাহউদ্দিনসহ ঘনিষ্ঠজনদের ১২১ ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ Dec 01, 2025
img
খুলনায় ৮ দলের বিভাগীয় সমাবেশ আজ Dec 01, 2025
img
নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার বার্তা জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রুতি দাসের Dec 01, 2025
img
দুলকার সালমানের নতুন লুক প্রকাশ, ভক্তদের উচ্ছ্বাস Dec 01, 2025
img

সাদ্দাম হত্যাকাণ্ড

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা দিলীপ গ্রেপ্তার Dec 01, 2025
img
সাতসকালে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ঢাকার বাতাস, তালিকায় ৪র্থ অবস্থান Dec 01, 2025
img

প্লট বরাদ্দে জালিয়াতি

হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের রায় আজ Dec 01, 2025
img
দেশের বাজারে কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ? Dec 01, 2025
img
আজকের আবহাওয়া : ঢাকায় আকাশ মেঘলা থাকতে পারে Dec 01, 2025
img
০১ ডিসেম্বর : ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা Dec 01, 2025
img
নারীর এগিয়ে চলায় নতুন বার্তা দিলেন রচনা ব্যানার্জি Dec 01, 2025
img
কিংবদন্তি ক্রিকেটার ধোনির ফিটনেস রহস্য! Dec 01, 2025
img
শীতে ফুসফুস ভালো রাখবে ৮ ধরনের ফল ও সবজি Dec 01, 2025
img
বিয়ে মানে দায়িত্ব,নতুন বার্তায় অপরাজিতা আঢ্য Dec 01, 2025
img
প্রথম সারির নায়িকারাও আমার থেকে কম টাকা কামায়: সোফী Dec 01, 2025
মাইনাস-টু প্রজেক্টে তৎপর ডিপ স্টেট- দাবি মাসুদ কামালের Dec 01, 2025
বেগম জিয়ার স্মরণে—সাবেক বিএনপি নেতার আবেগঘন বার্তা Dec 01, 2025
দুর্নীতি মামলার আগেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাইলেন নেতানিয়াহু Dec 01, 2025
প্লেয়ার ড্রাফটে হতাশ নোয়াখালীবাসী, তবু ‘নোয়াখালী এক্সপ্রেস’-এ প্রত্যাশা অটুট Dec 01, 2025