ছোট কাজে এলিট ফোর্স র‌্যাবকে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন, তদন্তের ক্ষমতা চায় এপিবিএন

পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ‘র‌্যাব আইন-২০২৪’ (খসড়া) প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। একইসঙ্গে র‌্যাবের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে মানবাধিকার সেল গঠন করা হয়েছে।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) তিনদিনব্যাপী চলমান পুলিশ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন র‌্যাবের পক্ষ থেকে প্রেজেন্টেশনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান।

তিনি জানান, র‌্যাব সদস্যদের শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ যেকোনো অনিয়ম ও অপেশাদার আচরণ প্রতিরোধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেলকে আরও যুগোপযোগী ও কার্যকরভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ব্যবস্থা আরও জোরদার হবে।

প্রেজেন্টেশন উপস্থাপনের পর পর্যালোচনায় র‌্যাবের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সমালোচনা করেন অংশগ্রহণকারী অনেক কর্মকর্তা। কেউ জুলাই আন্দোলনে র‌্যাবের বিতর্কিত ভূমিকা, বিগত সময়ের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। র‌্যাব বিলুপ্তি হলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে-তা নিয়েও আলোচনা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দিনভর কয়েক দফায় পুলিশ অডিটোরিয়ামে তাদের কর্মকাণ্ড, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনা করে সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন, রেলওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ ও শিল্পাঞ্চল পুলিশ।

অধিকাংশ ইউনিট তাদের সফলতার ফিরিস্তি উপস্থাপনের পাশাপাশি অপ্রতুল দক্ষ জনবল, পরিবহন সংকট, তদন্ত ব্যয় ও অভিযানের খরচ বাড়ানোসহ ব্যবস্থাপনার অর্থ ও অন্যান্য কাঠামোগত সংকটের কথা তুলে ধরেন।

তবে অন্যান্য ইউনিটের প্রবন্ধের ওপর তেমন সমালোচনা না হলেও র‌্যাব ও এপিবিএন এর বিষয়ে সমালোচনা হয়।

ইউনিটগুলোর প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোলিং, মাদকবিরোধী অভিযানের মতো ছোট কাজে এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাবকে ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন কয়েকজন কর্মকর্তা। এছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যা, জুলাই আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য জড়িত র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও ওঠে।

আলোচনায় অংশ নেওয়া এক ডিআইজি বলেন, একটি এলিট ফোর্স হিসেবে প্রত্যাশা হচ্ছে র‌্যাব বড় বড় কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে র‌্যাব খুচরা কাজ করছে। র‌্যাব কেন ফুট পেট্রোলিং, মাদকবিরোধী অভিযানে যাবে?

এসব প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, র‌্যাব সাধারণত খুচরা কাজ করে না। তবে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে বেশ কিছু ছোট কাজ করেছে র‌্যাব।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, র‌্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনী থেকে পদায়নের ক্ষেত্রে যে আনুপাতিক হার তা মানা হচ্ছে না। যেমন ১৫টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে পুলিশ থেকে আসা কমান্ডিং অফিসারের সংখ্যা মাত্র চারজন। ১১ জনই প্রধান হয়েছেন একটি বিশেষ বাহিনী থেকে। এ কারণে পরিদর্শক এবং এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা র‌্যাবে পদায়ন হতে চান না।

বিভিন্ন বাহিনী থেকে র‌্যাবের জনবল পদায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা আছে উল্লেখ করে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই সমন্বয়হীনতা রোধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, র‌্যাব মহাপরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।

এর আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার রেশ টেনে র‌্যাবকে বিতর্কিত এবং কলঙ্কিত উল্লেখ করে ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, আয়নাঘরসহ আওয়ামী লীগ আমলে গুম এবং খুনের সঙ্গে যে-সব র‌্যাব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, এ বিষয়টিও জানতে চাওয়া হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে পুলিশের এক ডিআইজি বলেন, পুলিশের বাজেটের বড় একটি অংশ র‌্যাবের পেছনে ব্যয় হলেও আউটপুট সে তুলনায় কম।

এসব প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, সরকার একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করেছে, তারা তদন্ত করছে। সেগুলো নিয়ে গুম কমিশন তদন্ত করছে। ৫ আগস্টের পর র‌্যাব কোনো গুম-খুনে জড়ায়নি।

‘শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সরকার এলে বিলুপ্ত হতে পারে র‌্যাব। এক্ষেত্রে র‌্যাবের জনবল, সম্পদ এবং স্থাপনা কীভাবে কার কাছে হস্তান্তর করা হবে’? আরেক কর্মকর্তার এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব ডিজি বলেন, র‌্যাব বিলুপ্ত হলে, সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

র‌্যাব ডিজি, র‌্যাবের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে জনসাধারণের আস্থা অর্জন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জনসাধারণের সঙ্গে র‌্যাবের যোগাযোগ সহজ করা, অভিযানিক সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

তিনি রিপোর্ট টু র‌্যাবকে আরও সহজ করার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন অভিযোগ গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি র‌্যাবের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অভিযোগ, তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইনানুগ সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন।

ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে অপরাধ তদন্তে অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, র‍্যাবে প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও চৌকস কমান্ডো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দ্বারা গঠিত র‍্যাব স্পেশাল ফোর্স রয়েছে। যা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যেকোনো অভিযান পরিচালনায় সক্ষম।

অভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে তিনি সাইবার অপরাধ ও ডিজিটাল অপরাধ দমনে আলাদা ইউনিট গঠন করে হ্যাকিং, অনলাইন প্রতারণা, উগ্রবাদী প্রচার, ডিজিটাল চাঁদাবাজি মোকাবিলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগের দাবি জানান।

জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তিনি বলেন, র‍্যাব ফোর্সেসের কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে র‍্যাব আইন ২০২৪ (খসড়া) প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মানবাধিকার সেল গঠন করা হয়েছে। র‍্যাবের সব কার্যক্রমের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে র‍্যাব আয়োজিত মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করছে।

প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষায়িত আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ যেমন- জাতিসংঘ পিসকিপিং, ইন্টারপোল, এফবিআই একাডেমি বা উন্নত দেশের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম আয়োজনের ওপরে জোর দেন।

তদন্ত ভার চায় এপিবিএন
এপিবিএনের প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন এপিবিএন প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. আলী হোসেন ফকির। তিনি ব্যাটালিয়ন সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। বিকাশ এবং নগদ প্রতারণার ৯২ লাখ টাকা উদ্ধার করে ভবিষ্যতে এপিবিএনকে মামলার তদন্ত ক্ষমতা দেওয়ার দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি সব ব্যাটালিয়নে ৮৫০ জন করে জনবল দেওয়ার দাবি করেন।

পরে উত্থাপিত প্রেজেন্টেশনের ওপরে আলোচনার সময় আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এপিবিএনকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হলে তা হবে ভুল সিদ্ধান্ত।

এপিবিএনকে মামলার তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতারণার টাকা উদ্ধার এবিপিনের কর্মপরিধির মধ্যে পড়ে না। অপারেশনাল ফোর্স হিসেবে তদন্ত ক্ষমতা দিলে সে অভিজ্ঞতা ভালো নাও হতে পারে। কারণ অপারেশনাল ফোর্স হিসেবে র‌্যাবকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এছাড়া ট্যরিস্ট পুলিশের উপস্থাপনায় কক্সবাজারসহ বড় বড় পর্যটন জেলাগুলোতে জনবল বাড়ানোর দাবি জানানো হয়। এছাড়াও পিবিআইয়ের প্রেজেন্টেশনে মামলা তদন্তের সফলতার হারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

অন্যান্য ইউনিটগুলোও নিজেদের সাফল্যতার কথার পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি তোলেন। তার মধ্যে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো, দাফন ও সৎকারের জন্য তহবিল, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাধীন সাইবার ইউনিট গঠন, পুলিশ মেডিকেল কলেজ স্থাপন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ, এবং অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানান।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কুয়েটে রুটিন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিলেন অধ্যাপক ড. হযরত আলী May 01, 2025
img
পাক-ভারত উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক মহড়া May 01, 2025
img
হানিয়া আমির, মাহিরা খানসহ অনেক পাকিস্তানি তারকাদের ইন্সটা ব্লক করলো ভারত May 01, 2025
img
জামাইয়ের হাতে প্রাণ গেল শাশুড়ির May 01, 2025
img
আগামীকাল ‘বরবাদ’-এর ‘জিল্লু’ আসছেন ঢাকায় May 01, 2025
img
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শ্রমিকের জন্য সবকিছু করা হবে : দুলু May 01, 2025
img
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হলেন আইএসআই প্রধান May 01, 2025
img
দাবানলে বিপর্যস্ত ইসরায়েল, ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা May 01, 2025
img
ডেভিল হান্ট অভিযানে আটক আ. লীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নিলেন বিএনপি নেতা May 01, 2025
সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি বানিয়েছি সেই বাড়ি তারা ভেংগে দিচ্ছে May 01, 2025