পোপের অভিষেককে ঘিরে চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার আশঙ্কা

আগামী সপ্তাহে ভ্যাটিকানে ১৩৫ জন কার্ডিনাল গোপন বৈঠকে মিলিত হবেন, যেখানে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি নির্ধারণ করা হবে। বিশ্বজুড়ে মানুষ ভাবছে, কে হবেন পরবর্তী পোপ? তবে তাইওয়ানের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে অন্য প্রশ্ন ‘অভিষেকে আমাদের পক্ষ থেকে কে যাবেন?’

সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও একনিষ্ঠ ক্যাথলিক চেন চিয়েন-জেন কিছুদিন আগেই পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তাইওয়ানের প্রতিনিধি হিসেবে ভ্যাটিকান ঘুরে এসেছেন। এবার তিনি নিজে না গিয়ে চান, নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে-ই এই দায়িত্ব গ্রহণ করুন।

তবে কেন লাই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেননি, সে বিষয়ে সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে অনেকেই বলছেন, এর পেছনে রয়েছে বেইজিংয়ের চাপ। ভ্যাটিকান এখনো মাত্র ১২টি দেশের একটি যারা তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয় এবং ইউরোপে এটি একমাত্র দেশ। অতীতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টরা পোপ জন পল দ্বিতীয় এবং পোপ ফ্রান্সিসের প্রথম অভিষেকে অংশ নিয়েছিলেন।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ানের কূটনৈতিক অবস্থান আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ানকে তাদের একটি প্রদেশ হিসেবে দাবি করে এবং প্রয়োজনে সামরিকভাবে একীভূত করার হুমকি দিয়েছে। এক্ষেত্রে, চীন তাদের কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাইওয়ানকে একঘরে করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এবং অনেক দেশকে তাইওয়ানের বদলে চীনকে স্বীকৃতি দিতে রাজি করিয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই চাপই ভ্যাটিকানের উপরেও পড়েছে।

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পরে তাইওয়ান দ্রুত শোকবার্তা পাঠায় এবং জানায়, প্রেসিডেন্ট লাই-এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি পাঠানোই তাদের ‘প্রধান উদ্দেশ্য’। তবে ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম বিকল্প’ হিসেবে।কিছুক্ষণের মধ্যেই চেন চিয়েন-জেনকে প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অনুমান করা হচ্ছে, ভ্যাটিকান হয়তো চীনের চাপের মুখে লাই-এর অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করেছে বা নিরুৎসাহিত করেছে। যদিও তাইপে, বেইজিং এবং ভ্যাটিকান কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।

চীনও পোপের মৃত্যুতে দেরিতে শোকবার্তা পাঠিয়েছে। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে যেখানে তারা আবারও তাইওয়ানকে “অবিচ্ছেদ্য অংশ” বলে দাবি করে। চীন পোপের শেষকৃত্যে কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি, যা অনেকের মতে তাইওয়ানের উপস্থিতি ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গবেষক মিশেল শ্যাম্বন বলেন, আমরা জানতাম চীন চাইবে না তাইওয়ান আসুক, এবং ভ্যাটিকানও তাদের রাজি করাতে পারবে না, আবার তাইওয়ানকেও ফিরিয়ে দিতে পারবে না, কারণ তারা এখনো কূটনৈতিক মিত্র এবং তাইওয়ানে ক্যাথলিক জনগোষ্ঠী রয়েছে।

এই ধরনের অনুষ্ঠানে তাইওয়ানের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে সম্মান জানানো নয়; এটি একটি বিরল সুযোগ যেখানে তারা অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। চেন জানান, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন।

ভ্যাটিকানের দৃষ্টিতে তাইওয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সঙ্গী, যদিও বিশ্বের মোট ক্যাথলিক জনসংখ্যার মাত্র ০.০২% সেখানে বাস করে। চেন বলেন, এটি একটি “ব্রিজিং চার্চ”—হিসেবে কাজ করে। এক দশক আগেও অনেক চীনা যাজক ও সন্ন্যাসিনী চুপিচুপি তাইওয়ানে গিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন।

পোপ ফ্রান্সিস চীনা ভাষাভাষী ক্যাথলিকদের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বক্তব্যে একমাত্র এশীয় ভাষা হিসেবে ম্যান্দারিন ভাষায় প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। চীনে প্রায় ১.২ কোটি ক্যাথলিক রয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ফ্রান্সিস বেইজিংয়ের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা করেছিলেন।

তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটিকান-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ থমাস তু বলেন, আমরা জানি না নতুন পোপ ফ্রান্সিসের মতো চীনকে ভালোবাসবেন কিনা, তবে ভ্যাটিকান সেই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়।

মিশেল শ্যাম্বন বলেন, ফ্রান্সিস সফলভাবে দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করলেও তাইওয়ানকে অবজ্ঞা করেননি। ভ্যাটিকান, পৃথিবীর কোনো ক্যাথলিক গোষ্ঠীকেই পরিত্যাগ করতে চায় না; তাইওয়ানকেও নয়। তারা বেইজিংয়ের চাপ সত্ত্বেও কৌশলে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।

তাইওয়ানের সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কে হবে তাদের প্রতিনিধি, তবে শ্যাম্বনের ধারণা, ভ্যাটিকান হয়তো চায় আবারও চেন চিয়েন-জেন যাক। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান।

আরএ/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভূমধ্যসাগরের তীরের ভূখণ্ডকে স্বীকৃতি দিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিচ্ছেন ম্যাক্রোঁ Jul 05, 2025
img
পাঠ্যবইয়ের ভুল চিহ্নিত করতে শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষা বোর্ডের আহ্বান Jul 05, 2025
img
পুলিশের মোরাল ফেরানো অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র টার্গেট: মাহমুদুর রহমান Jul 05, 2025
img
মালয়েশিয়ায় ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক হওয়া ৩ জনকে কারাগারে পাঠাল আদালত Jul 05, 2025
img
গ্রহণযোগ্য পরিবেশ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না : জামায়াত নেতা Jul 05, 2025
img
প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির আগেই বাজিমাত ‘ওয়ার ২’ সিনেমার! Jul 05, 2025
img
শাহবাগে আইন উপদেষ্টার প্রতীকী কফিন নিয়ে মিছিল Jul 05, 2025
img
দুইটা বিয়ে করেছি, তিন নাম্বারের প্রস্তুতি চলছে: তিশা Jul 05, 2025
img
যাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে তারাই সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন চায়: সালাহউদ্দিন Jul 05, 2025
img
আমাদের এবারের আন্দোলন, এবারের কর্মসূচি নতুন দেশ গঠনের : নাহিদ ইসলাম Jul 05, 2025
img
ইমন-হৃদয়ের জোড়া হাফসেঞ্চুরি, সাকিবের ছোট ঝলকে লড়ার মতো পুঁজি বাংলাদেশের Jul 05, 2025
img
সৌরভ গাঙ্গুলীর বায়োপিকে রাজকুমার রাও, পরিচালনায় সুজিত সরকার Jul 05, 2025
img
ভারত ও বাংলাদেশ সফরের নতুন সময়সূচি, হবে ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বরে Jul 05, 2025
img
তারা মনে করছে- আমি একটা খারাপ মেয়ে, এটা আমি ডিজার্ভ করি: বাঁধন Jul 05, 2025
img
পবিত্র আশুরা অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠায় সাহস জোগাবে : প্রধান উপদেষ্টা Jul 05, 2025
img
জোতার শেষকৃত্যে ছিলেন না রোনালদো Jul 05, 2025
img
গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন, টুঙ্গিপাড়ার মানচিত্র বদল : রনি Jul 05, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নিহত ১, আহত ১৫ Jul 05, 2025
img
সিলেটে ৪৮ ঘণ্টার পণ্য পরিবহন ধর্মঘট শুরু Jul 05, 2025
img
ইসলাম সত্য, ন্যায় এবং শান্তির ধর্ম: প্রধান উপদেষ্টা Jul 05, 2025