লেবাননের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দাতাদের আস্থা ফেরানোই মূল লড়াই

ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১৪ মাসের ভয়াবহ যুদ্ধের পর চরম বিপর্যয়ের মুখে লেবানন। এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য গ্রাম ও শহর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল, পাশাপাশি বৈরুতের দক্ষিণের উপশহর। যুদ্ধের ক্ষত শুধু স্থাপনায় নয়, লেগে আছে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মানুষের মানসিকতায়ও।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব বলছে, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য লেবাননের দরকার প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ কোথা থেকে আসবে? লেবানন সরকারের আশা—বিদেশি দাতারা এগিয়ে আসবে, যেমন তারা ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর করেছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আলাদা।

দাতারা এখন সরাসরি অর্থ দিতে চাইছে না। কারণ তাদের মতে, লেবাননের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি অনেক পুরোনো সমস্যা। অতীতে সরকারি প্রকল্পে রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে এমন ঠিকাদারদেরকেই কাজ দেওয়া হয়েছে, যারা বাজেট বাড়িয়ে বিল করেছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নির্মাণ ব্যয় গড়ে ৩৫ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছে।

২০২০ সালে বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর দাতারা একরকম ঘোষণা করেছিল—আর নয়। তারা সরাসরি সরকারের হাতে টাকা না দিয়ে বিশ্বব্যাংক বা এনজিওদের মাধ্যমে কাজ শুরু করে।

এই কঠিন বাস্তবতায় লেবাননের নতুন সরকার এখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি একটি নতুন আইন পাস করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটার সব প্রক্রিয়া একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার (Public Procurement Authority - PPA) আওতায় আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য—রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া, যোগ্য সংস্থাকে কাজ দেওয়া।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই কর্তৃপক্ষ এখনো গঠনই সম্পূর্ণ হয়নি। যেখানে ৮৩ জন কর্মীর প্রয়োজন, সেখানে আছে মাত্র ৫ জন। ফলে এত বড় কাজ তদারকি করা কার্যত অসম্ভব। তবুও সংস্থাটির প্রধান জঁ এলিয়েহ বলছেন—ক্ষমতা যত কমই থাক, আমরা আইনের প্রয়োগে ছাড় দেব না।

আল জাজিরা খুঁজে বের করেছে, ইতিমধ্যেই ১৫২টি পুনর্গঠন প্রকল্পে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ হয়েছে। এর ৬০ শতাংশই চারটি বড় কোম্পানির হাতে, যাদের মধ্যে দুইটির রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ওয়াসিম মাকতাবি বলছেন, ‘এই রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো সহজে তাদের ফায়দার সুযোগ ছাড়বে না। এমনকি যদি রাজনীতি প্রভাব না-ও ফেলে, তবুও বড় কোম্পানিগুলোর দক্ষতা ও মূলধন বেশি হওয়ায় তারাই অধিকাংশ কাজ পেয়ে যাবে।’

বর্তমানে লেবানন সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি ৯৮০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প (LEAP) নিয়ে আলোচনা করছে, যা দিয়ে পুনর্গঠনের একটি প্রাথমিক ধাপ শুরু হবে। এতে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের প্রস্তাব আছে, যা ‘স্বচ্ছতা’র ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।

কিন্তু বৈরুতের স্থপতি ও নাগরিক সংগঠক আবির সাকসুক বলছেন, ‘২০২০ সালের বন্দরের বিস্ফোরণের পর যে পদ্ধতিতে পুনর্গঠন হয়েছিল—সেটি ছিল অসাম্যপূর্ণ ও বিভাজনমূলক। সেই অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তি হলে জনগণের আস্থা আরও কমে যাবে।’

তিনি চাইছেন—এইবারের পুনর্গঠন হোক একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া, যেখানে ক্ষতিগ্রস্তরা, স্থানীয় সংগঠন, এবং প্রাসঙ্গিক মন্ত্রণালয় সবাই অংশ নেবে। শুধু বিদেশি এনজিও নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও জবাবদিহিমূলক কাঠামোয় রাখতে হবে। সূত্রঃ আল-জাজিরা

আরএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্ব বাজারে ফের কমল স্বর্ণের দাম Nov 21, 2025
img
হাসিনা সরকার জনগণকে ভোটের সুযোগ না দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে : শামীম সাঈদী Nov 21, 2025
img
আমি ব্যতীত অন্য কেউ মনোনয়ন পেলে আমি তার পক্ষে ভোট চাইতাম : মান্নান Nov 21, 2025
img
সশস্ত্র বাহিনী জাতির আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে: তারেক রহমান Nov 21, 2025
img
ময়মনসিংহে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, যুবলীগ কর্মী গ্রেপ্তার Nov 21, 2025
img
বাংলাদেশে ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা জাতিসংঘের Nov 21, 2025
img
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে এবার মুখ খুলেছে পাকিস্তান Nov 21, 2025
img
রাশিয়ার জাল ভিসা ও টিকিটে কোটি টাকা প্রতারণার চক্রের হোতা আটক Nov 21, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের মতামত ছাড়াই খসড়া ঘোষণাপত্রে সম্মত জি২০ দূতরা Nov 21, 2025
img
রাফিয়ার বাড়িতে আগুন, আ. লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গ্রেপ্তার ৪ Nov 21, 2025
img
বিএনপির সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে মুখ খুললেন জোনায়েদ সাকি Nov 21, 2025
img
চোট কাটিয়ে মাঠে ফিরছেন ইয়ামাল, রাফিনিয়া ও গার্সিয়া Nov 21, 2025
img
ভারতকে হারানোর পর নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন আকবর Nov 21, 2025
img
পুরুষদের কাঁদতে নেই ভাবা ভুল: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় Nov 21, 2025
img
নিয়ম মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে : জামায়াত আমির Nov 21, 2025
img
ভূমিকম্পে নরসিংদীতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫, আহত ৭০ Nov 21, 2025
img
একসাথে সহকারী অধ্যাপক হলেন ১৮৭০ শিক্ষক Nov 21, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে আটক ৪০ Nov 21, 2025
img
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো চিন্তার খোরাক তৈরির কারখানা : শিশির মনির Nov 21, 2025
সরবরাহ থাকলেও কমছে না সবজির দাম Nov 21, 2025