ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের গল্প

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের সুখ, দুঃখ, অনুভূতি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম এই বাংলা ভাষা। আজ যেমন করে আমরা বাংলা ভাষায় আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছি, তা হয়তো সম্ভব হতো না। যদি না বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ও প্রতিবাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতো। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যে কয়জন তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন তাদের একজন ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার।

আব্দুল জব্বার ১০ অক্টোবর ১৯১৯ বা বাংলা ২৬ আশ্বিন ১৩২৬ বঙ্গাব্দ ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাছেন আলী এবং মাতার নাম সাফাতুন নেছা।

তার পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষ্টবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যয়নের পরে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। যুক্ত হন কৃষিকাজে। পিতাকে সার্বক্ষণিক কৃষিকাজে সাহায্য করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর।

পনের বছরে পরিবারের সবার অজান্তে গৃহত্যাগ করেন। নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন। সাহেব তাকে একটি চাকরি দিয়ে বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) পাঠান। সেখানে দশ-বারো বছর অবস্থান করেন। পরে নিজ গ্রামে ফিরে তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে (পিএনজি) যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে নিজ গ্রামে ‘আনসার কমান্ডার’ হিসেবে কাজ করেন।

১৯৪৯ সালে আব্দুল জব্বার আমেনা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আমেনা-জব্বার দম্পতির নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তার ক্যান্সার আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসা করাতে জনাব সিরাজুল ইসলামের সহযোগিতায় শাশুড়িকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করান। হাসপাতালে তার শাশুড়িকে ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে (২০/৮) উঠেন। সেখানে রাত যাপন করে দিনে শাশুড়িকে সেবা করতে চলে আসতেন।

তখন ঢাকা মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে ছাত্র জনতা সোচ্চার। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ঢাকার রাজপথ। তখন তিনি মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া রোগী তার শাশুড়ির শয্যা পাশে বসা থাকতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে সিরাজুল ইসলামের সাথে শাশুড়ির রোগের ব্যাপারে কথা বলে তিনি মেডিক্যালের গেইটের বাইরে শাশুড়ির জন্য কিছু ফল কিনতে গেলেন। ওই সময় তিনি দেখেন রাষ্ট্র ভাষার দাবী বেশ কিছু ছাত্র-জনতা ব্যানারসহ সমবেত হয়েছে এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে অনবরত শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল জব্বার আর স্থির থাকতে পারেনি তিনি অসুস্থ শাশুড়ির জন্য ফল নেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে ব্যানার হাতে মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ান। ওই সময়ে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলাগুলি শুরু হয়, এতে আব্দুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওইদিন রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে তাকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

শহীদ আবদুল জব্বারের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৮ সালে তার নিজ গ্রামে ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়। আর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে জব্বার নগর।

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024