ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন এলাকা ভারি বর্ষণের পর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণের কারণে শহরটিতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
বেঙ্গালুরুর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, আন্দামান সাগরে ঘুর্ণিঝড় পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় বেঙ্গালুরুতে মঙ্গলবার আরও বৃষ্টিপাত হতে পারে। বর্ষণের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও জনগণের ভোগান্তি প্রশমনে শহরজুড়ে সতর্কতা জারি করেছে স্থানীয় আবহাওয়া বিভাগ।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় এই শহরে সোমবার বৃষ্টি-সংশ্লিষ্ট একাধিক ঘটনায় ১২ বছর বয়সী এক শিশুসহ অন্তত তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিশ্বের প্রধান প্রধান বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির কার্যালয় রয়েছে বেঙ্গালুরুতে। ভারি বৃষ্টির পর সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতায় অনেক কোম্পানি তাদের কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে।
সোমবার বেঙ্গালুরু শহরের অনেক জায়গায় ১০০ মিলিমিটার (প্রায় ৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে; যা ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। আঞ্চলিক আবহাওয়া দপ্তরের পরিচালক সি এস পাতিল বলেন, বেঙ্গালুরুতে এই বৃষ্টিপাত ‘‘অস্বাভাবিক’’। ভারি বর্ষণের কারণে শহরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা ও যানজটের পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে।
সোমবার সকালের দিকে শহরের অন্যতম আইটি করিডোরে ‘আই-জেড’ নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের প্রাচীর ধসে ৩৫ বছর বয়সী এক নারী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, হাঁটুপানিতে চলাচল করছেন লোকজন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনেক গাড়িও পানিতে ডুবে আছে। কিছু এলাকায় বাসার ভেতরেও পানি ঢুকেছে।
শহর কর্তৃপক্ষ বলেছে, বেঙ্গালুরুজুড়ে অন্তত ২১০টি বন্যাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় জনজীবন স্বাভাবিক করতে টানা কাজ করে চলছেন কর্মীরা। কর্ণাটকের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার বলেছেন, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দাদের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তবে শহরের ভঙ্গুর অবকাঠামো ও ডুবে যাওয়া রাস্তাঘাট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেছেন, ‘‘বেঙ্গালুরুর মতো আর কোনও শহরে বৃষ্টির সময় যাতায়াতে এত ভীতিকর ও অসহায় পরিস্থিতি তৈরি হয় না।’’
আট বছর ধরে বেঙ্গালুরুতে বসবাস করে আনু ইত্তি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘বর্ষাকালে শহরের অবকাঠামো একেবারেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।’’
‘‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হলো, প্রযুক্তি খাতের চাহিদা মেটাতে যেসব নতুন এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানেই সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।’’ বেঙ্গালুরুর জননীতি বিষয়ক এই পেশাজীবী বলেন, ‘‘পরিবেশগত সীমাবদ্ধতার প্রতি সহনশীল ও সুসংহত নগর পরিকল্পনার অভাব এবং সরকারের জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে শহরবাসীকে এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে।’’
বর্তমানে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের ক্ষমতায় আছে কংগ্রেস। বিরোধী দলে থাকা বিজেপি অভিযোগ করে বলেছে, বৃষ্টি-সংশ্লিষ্ট সকল সমস্যা মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যদিও অবকাঠামো উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
রাজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১ হাজার কোটি রুপি (১১৭ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিজেপি। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার বলছে, বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্টি হওয়া এই সমস্যা বহুদিনের পুরোনো।
ডি কে শিবকুমার বলেন, ‘‘আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, সেগুলো নতুন নয়। বহু বছর ধরে বিভিন্ন সরকার এবং প্রশাসনের আমলে এসব অবহেলিত ছিল।’’
গত কয়েক বছর ধরেই বেঙ্গালুরুতে নিয়মিত বন্যা দেখা যায়। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা এই বন্যার জন্য শহরের লেক ও জলাভূমিতে দ্রুত ভবন নির্মাণ এবং দুর্বল নগর পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন।
৪৫০টিরও বেশি সফটওয়্যার কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ইনফরমেশন টেকনোলজির (এআইটি) প্রেসিডেন্ট আনন্দ রাও বিবিসিকে বলেছেন, ঘন ঘন এই ধরনের বন্যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ভোগান্তি ও বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, বেঙ্গালুরু রাজস্ব আয় ব্যক্তি পর্যায়ের কিংবা সম্পত্তির করের হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কিন্তু এর বিনিময়ে কোনও সেবা পাওয়া যায় না।
শহরের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য রাজ্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি।
আরএম/এসএন