পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য ঘিরে অস্বস্তি দিল্লিতে

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতি হয়েছে এক মাসেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু এর কৃতিত্বের দাবি নিয়ে চলছে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি, যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে অস্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েকদফা বক্তব্য দিয়ে দেশদুটির সংঘাত থামানোর কৃতিত্ব দাবি করেছেন।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়েছিল গত ১০ মে।

সেই তথ্য প্রকাশ্যে এনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তারই মধ্যস্থতায় দুই দেশের চলমান সংঘাত থেমেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় একাধিকবার বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্পের দাবি খারিজ করেছে।

এরপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প কৃতিত্ব দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার বুধবারের ফোনালাপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প সেই একই দাবি করেন।

পাকিস্তানের সেনা প্রধান ফিল্ড মার্শাল অসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বুধবার। তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের আগেই ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে।

সেই সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবারও বলেন, আমি একটা যুদ্ধ থামিয়ে দিলাম… আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি। আমার মনে হয় মোদী একজন অসাধারণ মানুষ। আমি গত রাতে তার সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা ভারতের মোদীর সঙ্গে একটা বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছি।

এরপর অসিম মুনিরের সঙ্গে তার দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, অসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্য শুল্ক এবং ভিসা নীতির বিষয় ছাড়া প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন ট্রাম্পকে ভারতের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বলতেও দেখা যায়নি।

কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ, অভিবাসীদের ভিসা নীতি এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ অভিবাসীদের সামরিক বিমানে করে ফেরত পাঠানোকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণে কিছুটা হলেও ভিন্ন সুর দেখা যায়।

সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, যুদ্ধবিরতির কৃতিত্বের দাবি নিয়ে মোদী ও ট্রাম্পের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য এবং সর্বোপরি সিম মুনিরকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাতেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তি বেড়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ঘটনাবলী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান অসিম মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের সাক্ষাতের আগের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের টেলিফোন আলাপ হয়।

ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধের পটভূমিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই জি-৯ সম্মেলন থেকে ফিরে এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্প ও মোদীর কথোপকথনের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বিবৃতি দিয়ে জানান, দুই নেতা তাদের আলোচনার সময় ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘর্ষ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন। তবে দুই নেতার মধ্যে মূলত আলোচনা হয়েছিল ভারতের অপারেশন সিন্দুর নিয়ে।

মিশ্রি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, পুরো ঘটনাক্রমে কোনো সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়নি।

বিক্রম মিশ্রির কথায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন।

কিন্তু অসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ভারতের বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, পাকিস্তানের দিক থেকে (যুদ্ধ) বন্ধ করার ব্যাপারে এই ভদ্রলোক (অসিম মুনির) অত্যন্ত প্রভাব খাটিয়েছিলেন।

ভারতের দিক থেকে মোদী এবং অন্যান্যরা ছিলেন। তারা (ভারত-পাকিস্তান) তো সেদিকেই (যুদ্ধের) এগিয়েই যাচ্ছিল এবং এই দুটিই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আমি থামালাম।

এরপরই প্রশ্ন উঠতে থাকে কেন কৃতিত্বের দাবিতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যআসছে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় কি তাহলে স্পষ্ট?

আমেরিকান থিংক-ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।

তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ উল্লেখ করেছেন, মোদী (দিল্লি যে বিবৃতি দিয়েছে) ট্রাম্পকে বলেছিলেন যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় কোনো মার্কিন মধ্যস্থতা ছিল না। অথচ পরে, ট্রাম্প বলেছেন, আমি যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছি।

ভারতের সঙ্গে অংশীদারিত্বের একজন শক্তিশালী সমর্থক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্ভবত দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার সবচেয়ে বড় বিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।

সাবেক কূটনীতিক ও লেখক রাজীব ডোগরা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কিছুটা হলেও ছন্দপতন হয়েছে।

তবে তিনি মনে করেন , প্রতিটা ছোট ছোট কথা ধরে তার বিরুদ্ধে বারবার যাওয়াটাও ঠিক নয়, কারণ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিক্ততা আসতে শুরু করেছে ট্রাম্পের এই জাতীয় ভিত্তিহীন দাবির কারণে। এই বিষয়টাকে এখানেই শেষ করাই হবে বিচক্ষণতা। কারণ ভারত নিজের অবস্থানের কথা ইতিমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছে।

একসময় পাকিস্তানের করাচিতে ভারতের কনসাল জেনারলের দায়িত্ব পালন করেছেন রাজীব ডোগরা।

তার মতে, এটা প্রায় নজিরবিহীন ঘটনা, যে সেনাবাহিনীর প্রধানকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে ইরানের বিষয়ে মুনিরের সঙ্গে আলোচনা করাটাও হয়তো একটা বিষয়।

পাকিস্তানের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবস্থানে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, সে কথা মনে করেন মাইকেল কুগেলম্যানও।

মানব রচনা ইন্সটিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজ-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উপমন্যু বসু। তার কথায়, হয়তো খুব নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ভূ-রাজনীতির দিক থেকে পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেওয়ার একটা কারণ থাকতে পারে এবং এর একটা কারণ হলো চীন।

চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের নৈকট্য সবার জানা। চীনের প্রভাবকে ব্যালেন্স করতে হয়তো চাইছে তারা।

যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য সম্পর্কেও তার মতো জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, কূটনীতিতে প্রতিটা কথার গুরুত্ব রয়েছে এবং সে কথা মাথায় রেখেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মন্তব্যকে বিচার করা হয়। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। তিনি তার মন্তব্যের মাধ্যমে জাহির করতে চেয়েছেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গভীরতা এবং দুই রাষ্ট্রনেতার বক্তব্যে মিল না হওয়া নিয়ে বড় কোনো প্রভাব পড়বে। আর আমার মনে হয় না, যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের মতো সহযোগীকে হারাতে চাইবে। তাই বিষয়টা আর বেশিদূর গড়াবে না বলেই অনুমান।

সূত্র: বিবিসি

এফপি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

আশুলিয়ায় ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার, গ্রেফতার-২ Jun 20, 2025
img
পুলিশের বিশেষ অভিযানে ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেফতার ১৭৮২ জন Jun 20, 2025
img
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ সারজিস আলমের Jun 20, 2025
img
কপিলের শোয়ে সালমানকে নকল করে হইচই ফেললেন সুনীল Jun 20, 2025
img
আক্রমণ অব্যাহত থাকলে জবাব আরও তীব্র হবে : দাবি ইরানের প্রেসিডেন্টের Jun 20, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পারমাণবিক পরিকল্পনায় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত রাশিয়ার Jun 20, 2025
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের মর্যাদাবান মানুষদের আনন্দিত করেছে: খামেনি Jun 20, 2025
আশুলিয়ায় ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার, গ্রেফতার- Jun 20, 2025
img
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে পাখির ধাক্কা, ফিরতি ফ্লাইট বাতিল Jun 20, 2025
img
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে বহুমুখী ক্ষতিতে ইসরায়েল Jun 20, 2025
img
সিলেট সীমান্তে জব্দ দুই কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য Jun 20, 2025
img
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তায় চীনের নতুন অনুদান Jun 20, 2025
img
জো রুট ভাঙতে পারেন দ্রাবিড়ের রেকর্ড Jun 20, 2025
img
অনলাইনে আম বিক্রি করছেন ওমর সানী Jun 20, 2025
img
রাত ১টার মধ্যে যেসব এলাকায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড় হতে পারে Jun 20, 2025
img
এশিয়ান কাপ আরচ্যারিতে বাংলাদেশের হয়ে সোনা অর্জন আলিফের Jun 20, 2025
ইলন মাস্কের রকেটের আরেকটি ব্যর্থতা! Jun 20, 2025
দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত নোয়াখালীতে, রাস্তায় মাছ ধরলেন বাসিন্দারা! Jun 20, 2025
সাইকেলে এমন উঁচুতে? ১৫০ কিমির চরম এক অ্যাডভেঞ্চার! Jun 20, 2025
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ বিএনপি নেতার Jun 20, 2025