এক সময় শুধু শিশুদের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও, আজ অ্যানিমেশন হয়ে উঠেছে এক বিস্তৃত, শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্প বলার প্ল্যাটফর্ম। প্রযুক্তির বিপ্লব, সমাজের রুচি ও দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে অ্যানিমেশনের রূপ ও গুরুত্ব। মিকি মাউসের সরল সাদাকালো হাসি থেকে শুরু করে মোয়ানার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় — অ্যানিমেটেড চরিত্রেরা হয়ে উঠেছে সময়ের সাক্ষী।
১৯২৮ সালে স্টিমবোট উইলি-র মাধ্যমে জন্ম নেয় এক ছোট্ট চরিত্র — মিকি মাউস। এটাই ছিল প্রথম অ্যানিমেশন, যেখানে সাউন্ড সিঙ্ক্রোনাইজ করে চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করা হয়। মিকির হাত ধরেই শুরু হয় চরিত্রনির্ভর গল্প বলার এক নতুন ধারা, যা আজও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের দশক — অ্যানিমেশনের স্বর্ণযুগ। ডিজনি ও ওয়ার্নার ব্রাদার্স হয়ে ওঠে শীর্ষ নির্মাতা। বাগস বানি, ডোনাল্ড ডাক, টম অ্যান্ড জেরির মতো চরিত্রেরা শুধু হাসি নয়, যুদ্ধোত্তর যুগের আশাবাদ, সমাজের টানাপোড়েনও প্রকাশ করেছে নিজেদের ঢঙে।
১৯৯৫ সালে ‘টয় স্টোরি’ মুক্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় সিজিআই (কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ) যুগ। পিক্সার এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রযুক্তির নতুন দ্বার উন্মোচন করে। এরপর শ্রেক, ফাইন্ডিং নিমো, দ্য ইনক্রেডিবলস—প্রতিটি ছবি দর্শকের চোখে জল এনে দেওয়ার মতো আবেগময় গল্প এবং দৃষ্টিনন্দন ভিজ্যুয়াল উপহার দেয়।
২০১০-এর দশকে অ্যানিমেশন চলে আসে কেবল মজা নয়, পরিচয় ও সংস্কৃতির গভীর ব্যাখ্যায়। মোয়ানা পলিনেশিয়ান সংস্কৃতিকে, কোকো মেক্সিকান পারিবারিক মূল্যবোধকে, আর রায়া অ্যান্ড দ্য লাস্ট ড্রাগন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কাহিনি তুলে ধরে। অ্যানিমেটেড হিরোরা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের প্রতিবিম্ব — রক্ত-মাংসের মতোই মানবিক।
আমরা এখন এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণে। এআই ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সমন্বয়ে গড়ে উঠছে হাইপার-রিয়েল অ্যানিমেশন জগত। নতুন নতুন কণ্ঠস্বর, নতুন নির্মাতা বদলে দিচ্ছেন অ্যানিমেশনের ভাষা। চরিত্রেরা আর কেবল কার্টুন নয়, তারা হয়ে উঠছে জীবনের গল্প বলা এক শক্তিশালী মাধ্যম।
মিকি মাউসের মৃদু সিটি থেকে শুরু করে মোয়ানার আত্মউন্মোচন — অ্যানিমেশন কেবল বিনোদনের খোরাক নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের মানসিক বিবর্তনের এক বিশাল দলিল। আগামী দিনের মিকি হয়তো উঠে আসবে আফ্রিকার গ্রাম থেকে কিংবা বাংলাদেশের কোনো ছোট্ট স্টুডিও থেকে — কারণ এখন অ্যানিমেশন আর সীমাবদ্ধ নয় কোনও একদেশীয় কল্পনাজগতে, এটা এখন এক বৈশ্বিক শক্তি।
আরআর