জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে জল, নদী, জঙ্গল, পাহাড়, প্রকৃতি! যাপনের সঙ্গেও! মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যুর দীর্ঘ যাপিত জীবনে প্রকৃতির অবদান অনস্বীকার্য! জাগতিক উন্নয়নের অজুহাতে সেই প্রকৃতির নিয়ম বেনিয়মে লঙ্ঘন করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই। নিচ্ছেও। সেটা আমরা প্রাত্যহিক জীবনে লক্ষ করছি, জীবন দিয়ে উপলব্ধিও করছি। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে উন্নয়নের প্রয়াস বিপরীতভাবে দ্বিগুণ হয়ে প্রতিশোধ নেই।
আজকের জলবায়ুর চিরন্তন ধারাটাই কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে সেটা তো বুঝতেই পারছি নিজস্ব অভিজ্ঞতায়! গৌতম ঘোষ প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে ‘পরিক্রমা’ নামের তাঁর নতুন ছবিতে মানুষ্যকৃত সেই ভুলের ফল কেমন হচ্ছে তারই একটি খন্ডচিত্র তুলে এনেছেন। শুধু সমালোচনা নয়, চলতি বাস্তবের চিত্রায়নের পাশাপাশি তিনি এক শিল্পোত্তীর্ণ সিনেমা ও সমাজ সচেতনতারও পরিচয় রেখেছেন। ছবিটি শেষ হওয়ার পর নর্মদার বুকে হারিয়ে যাওয়া অগণিত সর্বহারা মানুষদের জন্য সেই কারণেই দর্শকের বুকে একটা হতাশা ও নীরব ব্যথা তৈরি করে দেয়। এখানেই পরিচালক গৌতম ঘোষের কৃতিত্ব ও জয়।

সুদূর ইতালির নেপলস সহর থেকে আলেক্স(মার্কো লিওনার্দি,) নামের এক তথ্যচিত্র নির্মাতা মুম্বই আসেন নর্মদা নদীর ধর্মীয় পরিক্রমা নিয়ে একটি ছবি বানাতে। তাঁকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন রূপা(চিত্রাঙ্গদা সিং) যিনি নর্মদা আন্দোলন নিয়ে একটি বই লিখেছেন। আলেক্সের ছবির সহযোগী রূপাও। নর্মদার উৎস অমর কন্টকে শুটিং করতে গিয়ে আলেক্সের সঙ্গে পরিচয় ঘটে কিশোর গরিব ফেরিওয়ালা লালার (আরিয়ান বাদকুল)। এই কিশোরের বাবা নর্মদার জলেই হারিয়েছে তাদের ক্ষেতি জমি, বসতবাড়ি সব। সরকার নর্মদার বুকে একের পর এক বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, মহারাষ্ট্র, গুজরাত তিনটি রাজ্যের কোটি কোটি দরিদ্র জনজাতিকে গৃহহারা করেছে। তাঁদের অনেকেই সরকারি পুনর্বাসন বঞ্চিত। বিশেষত যাঁরা নর্মদা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লালার কাছ থেকে তার এই বিপর্যয়ের কাহিনি শুনে আলেক্স তাঁর তথ্যচিত্রের উদ্দেশ্য বদলে ফেলেন! ধর্মীয় পরিক্রমা থেকে সরে গিয়ে মুখ্য হয় লালার মতো গৃহহারাদের কথা। তাঁর ক্যামেরা তখন থেকে ঘুরে যায় সাধারণ মানুষের অসহায়তার দিকে। লালাই হয়ে ওঠে ছবির প্রধান প্রোটাগনিস্ট!
ছবির শেষ পর্ব ওমকারেশ্বরে নর্মদার বিশাল বাঁধের সামনে। তার বিপরীত বিশাল জলাশয় তৈরি হয়েছে শহুরে বিলাসী টুরিস্টদের জন্য “ওয়াটার স্পোর্টস”এর জন্য। যেখানে চলছে খানাপিনার আধুনিক রেস্তোরাঁ, স্কুবা ডাইভিং, ওয়াটার স্কিইং ইত্যাদি আমোদের ব্যবস্থা। আর কিশোর লালা তখনও জানে না তার মা বাবা দিদি কোথায় কীভাবে আছে বা আদৌ আছে কিনা। আলেক্স ছবির শুটিং শেষ করার পর চেয়েছিল লালাকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে, আর যথাসম্ভব আর্থিক সাহায্য করবে ওঁর বাবাকে পুনর্বাসনের। জাহাজ নিয়ে তারা রওনাও হয়, কিন্তু পরিচালক গৌতম ঘোষ অসমাপ্ত রাখেন সেই পরিক্রমা। দূর পাহাড়ে ভিল জনজাতির সঙ্গে হয়তো লালার পরিবার ওখানেই রয়েছে! নাকি তাঁরা জলের তলায় সমাধিস্থ – কে জানে! গৌতমের ক্যামেরা জলের তলায় গিয়ে বাড়ি ঘরের ধ্বংস অবশেষেরর ছবি দেখিয়েছেন আলেক্সির মনিটরে! জাহাজ আর পাহাড়ের দিকে এগোয়নি।
লালার মতো কোটি কোটি মানুষ ও সংসারের জলসমাধি ঘটে গেছে। এখন সেখানে শ্মশানের শান্তি ও উন্নয়নের ঝলকানি! গৌতম ঘোষের মানবিকবোধের সঙ্গে তাঁর পরিচালনার কাজেও মিলন ঘটেছে একজন সংবেদনশীল শিল্পীর সচেতনতা, যা তাঁর আগের দুটি ছবিতে তেমন স্পষ্ট ছিল না। গৌতমের প্রয়োগ প্রকরণ, লোকেশন নির্বাচন, ক্যামেরার কোরিওগ্রাফি, ছবি জুড়ে নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর শটস, ইতালির লোকেশনতো বটেই, নর্মাদর তীর, ওই বিশাল নদীর ব্যাপক চেহারাগুলো সিনেমাটিক ভাষায় ফুটে উঠেছে। মাঝে মাঝে “পদ্মা নদীর মাঝি” এবং “পাড়” মনে করিয়ে দেয়। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যেন পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে আরও বাঙ্ময় করে তোলে।
অভিনয়ের নিরিখে প্রথম নাম অবশ্যই অবশ্যই লালা। এই চরিত্রের আনকোরা মুখ আরিয়ান বাদকুল! কী স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ত জীবন্ত অভিনয়। এমনকি বাঁশি বাজানোর নকল অভিনয়ও। বাকি শিল্পীদের সব্বাই মার্কো লিওনার্দি, চিত্রাঙ্গদা সিং, মার্কোর কিশোর সন্তান ফ্রান্সিসকোর চরিত্রে ইমানুয়েল, লালার মা ও বাবার চরিত্রে উর্মি ও অশ্বিনী এবং ছবির ক্যামেরাম্যানের চরিত্রের শিল্পী। সক্কলেই অভিনয় করেননি, স্বাভাবিক আচরণ করেছেন।
আর বাড়তি নজর কেড়েছেন এক পাগলা ভিল জনজাতির মানুষের ভূমিকায় দাদুল নামে পরিচিত মানুষটি, যাঁর পোশাকি নাম অরিজিৎ দত্ত। মাত্র দু তিনটি দৃশ্যে নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিরোধী পাগল মানুষটি “ডুব গাও ডুব গাও” চিৎকারে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের স্ফূরণ ঘটায় না, সরকারি আধিকারিকদের সভা ভণ্ডুলও করে দেয় নিজের জীবন দিয়ে। পরিচালক গৌতমের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত একবার সাবাশ দাদুল বলতেই হয়।
আরআর