ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহের পাশাপাশি হতাশাও রয়েছে: মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহ ও প্রত্যাশা যেমন অনেক তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে জনমনে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা যেমন ৬টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি তেমনি ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় আমাদের প্রতিনিধিরা কার্যকর অংশগ্রহণ করে চলেছেন।

তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য আমাদের প্রতিনিধিরা সভায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছেন।

রোববার (৬ জুলাই) সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যে সব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিংবা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী বলেই আমাদের প্রতিনিধিরা ধৈয্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্য প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগিতা করছেন।

রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোন প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দ্যেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে বিএনপি মনে করে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণকে জবাবদিহীতা করতে বাধ্য কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘষিক। ফলে এমন কোনো প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা নয় বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনও আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে আমাদের দলের প্রতিনিধিদের কাছে আমরা যতটুকু জেনেছি তাতে র‌্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

দুদক সংস্কার কমিশনে কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই আমরা সম্মতি জানিয়েছি। শুধু ২৯ নং সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আমরা আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছি। আমরা মনে করি এটা না হলে দুদকের কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশর মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি এবং ৫টিতে আংশিক একমত হয়েছি। ৫টি সুপারিশে আমরা ভিন্নমত প্রদান করেছি। ১১টি প্রস্তাবে আমরা একমত হতে পারিনি- যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসংগতির বিষয়ে। উল্লেখ্য, পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে আমরা একমত হয়েছি এবং ৯টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছি। ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছি। উল্লেখ্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সব প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা ইতোমধ্যে কোনো অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রিটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।

নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে আমরা একমত হয়েছি এবং ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছি। ৬৪টিতে আমরা ভিন্নমতসহ একমত হয়েছি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে তা প্রস্তাব করেছি। ২৪টি বিষয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। উল্লেখ্য, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ৬টি নীতিমালা রয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তাবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনীত সব প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আইনি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফা ওয়ারি মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৭০’ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও আমরা আমাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছি।

জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি সহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও আমরা একমত হয়েছি। বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে আমরা তা বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার মাধমে বাস্তবায়নে পরামর্শ দিয়েছি। কারণ ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে এমন উদ্যোগকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিল।

এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা একমত হয়েছি যেগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত দূরুহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনার এবং সংসদীয় কার্যক্রম দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।

ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্য নতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি দল কিংবা কমিশনের আছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি।

দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিএনপি শুধু টিকে থাকেনি বরং অধিকতর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়েছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, শত শহীদের রক্তে, গুম, খুনের শিকার সহকর্মীদের আত্মত্যাগে আর লাখো নেতা-কর্মীর অবর্ণনীয় দুঃখ-শোকে বিএনপির ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সমর্থ এবং দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি দেশে আবারও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে আমরাই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়।

কেএন/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মুক্তি পেল ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র ট্রেলার, কবে আসছে এই ছবি? Jul 17, 2025
img
গুটখা খেতে দেখে পাপারাজ্জিকে ধমক দিলেন শিল্পা শেট্টি! Jul 17, 2025
img
জুলাই আন্দোলনে মূল ভূমিকা ছিল তারেক রহমানের: টুকু Jul 17, 2025
img
নীলফামারী থেকে ঢাকায় ফেরার পথে অবরোধের মুখে ২ উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
টেকসই আর্থিক কার্যক্রমে শীর্ষে ১০ ব্যাংক ও ২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান Jul 17, 2025
img
অ্যাতলেটিকোয় যোগ দিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলার থিয়াগো আলমাডা Jul 17, 2025
img
'নিজের এবং দলের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল'- সিরিজ জয়ের পর লিটন Jul 17, 2025
img
কক্সবাজারে আহত ছাত্রদল নেতা অভির পাশে বিএনপি Jul 17, 2025
img
১৬ জুলাইতেই কেন এনসিপিকে গোপালগঞ্জে যেতে হল?- প্রশ্ন মাসুদ কামালের Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ: গুলিবিদ্ধ আরেক যুবক ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জের ঘটনায় সিলেটে এনসিপির ব্লকেড কর্মসূচি Jul 17, 2025
img
মেহেদীর বোলিংয়ের প্রশংসা করলেন আসালাঙ্কা Jul 17, 2025
img
সড়কে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি সংঘর্ষ Jul 17, 2025
img
কলম্বোতে মেহেদীর খেলার বিষয়টি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন লিটন Jul 17, 2025
img
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
দ্রুতই আবু সাঈদ হত্যার বিচার হবে, তাঁর বাবা এ বিচার দেখে যেতে পারবেন: আইন উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং Jul 17, 2025
img
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিচ্ছেন রাসেল Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়নি: মন্ত্রণালয় Jul 17, 2025
img
চলতি বছর স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা Jul 17, 2025