প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি `নিঝুম দ্বীপ'

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি.......

দিজেন্দ্রলাল রায় কতটা মুগ্ধ হয়ে এই কথাগুলি বলেছেন, সেটা নিঝুম দ্বীপের মতো জায়গায় গেলেই পরিপূর্ণ ভাবে অনুধাবণ করা যায়। প্রায় ১৪০৫০ একর আয়তনের এই দ্বীপটির দক্ষিনে রয়েছে সুবিস্তৃত খোলা সাগর এবং এক পাশে মনপুরা অন্য পাশে হাতিয়া দ্বীপ।

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই দ্বীপটির নামছিল চর-ওসমান। ওসমান নামের এক বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে এই চড়ে বসত গাড়েন। সেই থেকেই এই নামকরণ।  বল্লারচর, চর ওসমান, কামলার চর এবং চুর-মুরি  এই চারটি চর একসাথে মিলেই নিঝুম দ্বীপ।

দ্বীপটি ১৯৫০ সালে জেগে উঠে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দ্বীপটি নিঝুমই ছিল। দ্বীপের চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত থাকে, নিঝুম দ্বীপের তিনপাশে নদী, একপাশে সমুদ্রের ছোঁয়ামাত্র। তাছাড়া দ্বীপের সৈকতে বালু কিংবা পাথর থাকে, কিন্তু চরের সৈকতে থাকবে শ্রেফ কাদা আর কাদা।  ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ বনবিভাগ দ্বীপটি নিজেদের আওতায় নিয়ে আসে । পরে তারা পরীক্ষামূলক ভাবে ৪ জোড়া হরিণ ছাড়ে এবং দ্বীপটিকে হরিণের অভয়ারণ্য ঘোষনা করে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ি দ্বীপটিতে এখন বাইশ হাজারের উপর হরিণ রয়েছে। এর পাশাপাশি এটিকে কেওড়া গাছেরও অভয়ারণ্য  ঘোষনা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বনবিভাগ কিছু নোনা ঝাউ ও রোপন করেছে। হরিণ  ও মহিষ  ছাড়াও দ্বীপে আছে ৩৫ প্রজাতির রং বেরঙের পাখি।

শীতের মৌসুমে অজস্র পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় নিঝুম দ্বীপ।  শীতকালে নিঝুম দ্বীপে সরালি, জিরিয়া, লেনজা, পিয়ং, রাঙ্গামুড়ি, চখাচখি, ভূতিহাঁস, রাজহাঁস, কাদাখোঁচা, বাটান, জিরিয়া, গুলিন্দা, গাংচিল, কাস্তেচরা, পেলিক্যান ইত্যাদি হাজারো অতিথি পাখির আগমন ঘটে। স্থানীয় পাখির মধ্যে চোখে পড়ে সামুদ্রিক ঈগল, বক শঙ্খচিল। 

এছাড়া নিঝুম দ্বীপ মাছের জন্য বিখ্যাত। ভাটার সময়ে এখানে ধরা পরে হাজারো প্রজাতির মাছ। এখানে রয়েছে মারিসৃপারি নামের এক ধরনের উভচর মাছ যা ৬-৯ ইঞ্চি আকারের হয়ে থাকে। এই দ্বীপে কোন হিংস্র প্রাণী নেই। এছাড়া দ্বীপে রয়েছে হরিণ, বন্য শূকর, শেয়াল, বানর এবং নানা রকম সাপ। বাংলাদেশ সরকার এই দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করেছে।

 

দর্শনীয় স্থান

চোয়াখালি চোয়াখালি সী-বিচ: খুব সকালে চোয়াখালিতে হরিন দেখা যায়। ভাগ্য ভালো হলে নামার বাজারের পাশেই খুব ভোরে হরিন দেখা যায়।

চৌধুরী খাল কবিরাজের চর: এখানে বিকেল এ সন্ধ্যার আগে, চৌধুরীর খালে নেমে ঘন্টা খানেক হাঁটলেই বনের মধ্যে হরিন এর পালের দেখা পেতে পারেন। এছাড়াও সন্ধ্যার সময় কবিরাজের চরে নেমে সূর্যাস্ত ও হাজার হাজার মহিষের পাল দেখা যায়।

কমলার দ্বীপ: সেখানের কমলার খালে অনেক ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও আশেপাশের দ্বীপগুলোও সুন্দর। পুরো দ্বীপটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসা যায়, মন ভরে যাবে।

ম্যানগ্রোভ বন: নিঝুম দ্বীপ বনায়ন প্রকল্পে আছে কেওড়া গাছ আর লতাগুল্ম। নিঝুম দ্বীপে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাইড-এর কাজ করে।

নামার বাজার সী-বিচ: নামার বাজার থেকে হেঁটে যেতে ১০ মিনিট লাগে। এখান থেকে সূর্য উদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।

দমার চর: বঙ্গোপসাগরের কোলে সম্প্রতি আরো একটি অনিন্দ্যসুন্দর সমুদ্র সৈকত জেগে উঠেছে। সৈকতটি একেবারে আনকোরা। একে এখন ডাকা হচ্ছে 'ভার্জিন সি বিচ' বলে। এখানে খুব সকালে অনেক নাম না জানা পাখির দেখা পাওয়া যায়। ট্রলার ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা।

ভ্রমণের সময়:

উত্তম সময় হলো শীতকাল। সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত নিঝুম দ্বীপ ভ্রমনের জন্য উপযুক্ত সময়। বর্ষাকালে দ্বীপ একেবারে কাঁদাময় হয়ে থাকে।

গ্রীষ্মকালে রোদ আর হঠাৎ বৃষ্টির দেখা ভ্রমণ মাটি করে দিতে পারে। আর জুন-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসের ভয় থাকে|

ভ্রমণের উপায়:

নিঝুম দ্বীপ পানি বেষ্টিত থাকায় দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্য নৌকাই একমাত্র ভরসা। এবং তা জোয়ার ভাটার উপর র্নিভর করতে হয়। সাধারনত সারা দেশ থেকেই নিঝুমদ্বিীপে  যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে ভোলা গামী লঞ্চে হাতিয়া দ্বীপে সরাসরি  যাওয়া যায়। এরপর হাতিয়া থেকে ট্রলারে করে ৩ ঘন্টার মধ্যেই নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়।

এছাড়া নোয়াখালি হয়ে যেতে চাইলে  বাসে অথবা ট্রেনে নোযাখালীর মাইজদি পর্যন্ত। ঢাকা কমলাপুর থেকে উপকুল এক্সপ্রেস (বৃহস্পতিবার ছাড়া) প্রতিদিন বিকাল ৪.২০ মিনিটে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, মাইজদি পৌঁছে রাত ১০.২২ মিনিট। ভাড়া - ২৩০ থেকে ৫০৩ টাকা। নোয়াখালীর সোনাপুর / মাইজদি থেকে লোকাল বাস বা সিএনজিতে করে চেয়ারম্যান ঘাটে নামতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। টেম্পু বা বাসে খরচ আরো কম। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে সি-ট্রাক, ট্রলার ও স্পীড বোট যোগে হাতিয়া যেতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। এখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সা যোগে জাহাজমারা ঘাটে গিয়ে নৌকাযোগে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছা যাবে।

থাকার ব্যবস্থা:

১। নিঝুম রিসোট (নামার বাজার): অবকাশ পর্যটন লিমিটেড এর একটা রিসোর্ট হল নিঝুম রিসোর্ট যা নামার বাজার সীবীচ এর কাছে অবস্থিত। নিঝুম রিসোর্ট থাকার জন্য একটি ভালো মানের রিসোর্ট।

ভাড়াঃ ২ বেড এর  ভিআইপি রুমের ভাডা ২০০০ টাকা , ২ বেডের রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা। ৩ থেকে ৫ বেডের রুম ভাড়া ১৮০০০ থেকে ৩০০০ টাকা, ১২ বেড এর ডরমেটরি রুম ভাড়া ৩০০০ টাকা। প্রতিটিতে এটাচ ওয়াশরুম আছে। দুপুর ১২ টার আগে চেক আউট করতে হবে।  অফ সিজনে রুম ভাড়ায় ৫০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ( এপ্রিল ১৫- সেপ্টেম্বর ৩০ )।

ঢাকায় যোগাযোগ: অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, আলহাজ শামসুদ্দিন ম্যানশন (৯ম তলা), ১৭ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা। ফোন: ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ৯৩৫৯২৩০, ০১৫৫২৩৭২২৬৯।

নিঝুম রিসোর্টে যোগাযোগ: ইনচার্জ, নিঝুম রিসোর্ট, হাতিয়া, নোয়াখালী। ফোন: ০১৭২৪-১৪৫৮৬৪।

২। হোটেল শাহিন,নামার বাজার: ৪ বেডের এর রুম  ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা। ফোন নম্বরঃ ০১৮৬৩১৫০৮৮১

৩। হোটেল সোহেল,নামার বাজার: ৪ বেড এর রুম ২৫০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত। হোটেল শাহিন এবং সোহেল একই মালিকের এবং ভাড়া প্রায় সমান। ম্যানেজারঃ ০১৮৬৮৬১২১৩৫

৪। মসজিদ বোর্ডিং, নামার বাজার: এটা সবচেয়ে সস্তায় থাকার ব্যবস্থা। এক্সট্রা দুইটি সিঙ্গেল এবং দুইটি ডবল রুম আছে, আর সব ডরমেটরি । ডরমেটরি ভাড়া ২০০ - ৩০০ টাকা। তবে এই বোর্ডিং-এ কোনো এটাচ বাথরুম এবং বিদ্যুৎ জেনারটরের ব্যবস্থা নাই।

যোগাযোগঃ কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ, নামার বাজার।ফোনঃ ০১৭২৭-৯৫৮৮৭৯।

৫। নিঝুম ড্রিম ল্যান্ড রিসোর্ট, বন্দরটিলা: সম্প্রতি এটি উদ্বোধন হয়েছে। যোগাযোগঃ ঢাকা বুকিং অফিসঃ০১৮৪৭১২৩৫৭৩। নিঝুমদ্বীপ বুকিং অফিসঃ০১৮৪৭১২৩৫৭৩।

৬। হোটেল দ্বীপ সম্পদ,(সৈয়দ চাচার থাকা খাওয়ার হোটেল) নামার বাজার: ফোনঃ ০১৭২০ ৬০১ ০২৬, ০১৭৬০ ০০৮১০৬।

৭। হোটেল শেরাটন: বন্দরটিলা বাজার ।

৮। জেলা পরিষদ ডাক বাংলো: জেলা পরিষদের নির্মিত ডাকবাংলো বর্তমান নিঝুম দ্বীপ রিসোর্ট সেন্টার নামে পরিচিত ।  এর রুম ভাড়া প্রকার ভেদে ২০০-৮০০ টাকার মধ্যে।

৯। বন বিভাগের ডাকবাংলো:

৫০/৬০ জন পর্যটক থাকার ব্যবস্থা আছে। বন বিভাগের রেস্ট হাউজ। এটা দ্বীপের প্রথম রেস্ট হাউস। ভাড়া প্রতিজন ২০০ টাকা। নিজস্ব জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে রিসোর্ট সেন্টার।

যোগাযোগ:০১৭১১-১৭৩৪৩৪,০১৭১৫-৫৪৬৭৭২ ।

১০। মাহমুদ বোডিং (হোম স্টে):ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা। যোগাযোগ: ০১৭১৩-১১১৭৯৪ ।

খাবার খরচ: নাস্তার সর্বোচ্চ খরচ ৫০ টাকা এবং দুপুর/রাতের খাবারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হতে পারে । এখানে সবচেয়ে মজাদার খাবার হচ্ছে মাছ। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি ভাজা  পাওয়া যাবে। এছাড়াও কচি ডাব, মহিষের দুধ ও কেওড়া ফলের আচার পাওয়া যাবে।

ভুলেও হরিণের মাংস খুজবেন না। হরিণ জাতীয় সম্পদ। আপনি ডিমান্ড করলে স্থানীয়রা হরিণ শিকারে উৎসাহ পাবে।

ভ্রমণ পরামর্শ:

১)            ক্যাম্পিং করতে প্রয়োজনীয় সবই নামার বাজারে পাবেন।

২)           এই এলাকাটা জলদস্যুদের আস্তানা। তাই যথাসম্ভব সাবধান থাকাই শ্রেয়।

৩)           হরিণ দেখার সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো নামারপাড়া। সেখানে থাকাই শ্রেয়।

৪)           বর্তমানে প্রায় সকল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও নিঝুম দ্বীপে শুধুমাত্র রবি ও এয়ারটেলের ৩ জি সুবিধা পাওয়া যায়।

৫)           নিঝুম দ্বীপ সোলার এবং জেনারেটরের উপর নির্ভরশীল। তাই মোবাইলের এক্সট্রা ব্যাটারী কিংবা পাওয়ার ব্যাংক সাথে রাখুন। তবে প্রয়োজনে টর্চ, মোবাইল কিংবা ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জের জন্য এখানে দুটো দোকান আছে।

 

টাইমস/এএস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আজ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে ঢাকার আকাশ Nov 06, 2025
img
পরিমিত ক্যাফেইন উপকারী, অতিরিক্ত বিপজ্জনক Nov 06, 2025
img
হাসপাতালে ভর্তি জিতু কামাল Nov 06, 2025
img
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিসহ ১৮৪ অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের আটক Nov 06, 2025
img
বাস্তববাদী ইশতেহার আর ভিন্নধর্মী প্রচারণায় ভোটারদের মন জয় করেছেন মামদানি Nov 06, 2025
img
মনোজ বাজপেয়ীর শুটিং দিনের কষ্টের গল্প Nov 06, 2025
img
সবাই এখন নিজেকে বিচারক মনে করে: সুনীল শেট্টি Nov 06, 2025
img
জনগণের মতো সেনাবাহিনীও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় Nov 06, 2025
img
শক্ত হতে শিখিয়েছেন মা, তবে সেটা প্রচারের নয়: আনুশকা শর্মা Nov 06, 2025
img
উত্তমকুমারের কাছেই শিখেছি সহঅভিনয়ের পাঠ: লিলি চক্রবর্তী Nov 06, 2025
img
স্ট্রাগল করতে করতে বয়স কেটে গেছে: রাখি সাওয়ান্ত Nov 06, 2025
img
এস আলমের লোকজন এখন নমিনেশন পাচ্ছেন : কর্নেল অলি Nov 06, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার কাছে জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দলের স্মারকলিপি দেবে আজ Nov 06, 2025
img
নিউইয়র্ক থাকবে অভিবাসীদের শহর হিসেবে, বললেন মামদানি Nov 06, 2025
img

সাদিক কায়েম

জুবায়ের ও সর্ব মিত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে কালচারাল ফ্যাসিস্টরা Nov 06, 2025
img
ভার্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে জয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম হাশমির Nov 06, 2025
img
বড় বাজেটের ভিড়ে ‘দ্য তাজ স্টোরি'র বাজিমাত Nov 06, 2025
img
রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি ‘ভারতের রোনালদো-মেসি' : রশিদ লতিফ Nov 06, 2025
img
অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার দল নিয়ে সমালোচনা সাবেক অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর Nov 06, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Nov 06, 2025