বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. মোহাম্মদ আক্তার হোসেন। আগামী দুই বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। চুক্তিভিত্তিক এই নিয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর পূর্ণাঙ্গ প্রধান অর্থনীতিবিদ পেল বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোমবার (১৪ জুলাই) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ড. মোহাম্মদ আক্তার হোসেনকে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রধান অর্থনীতিবিদ পদে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি অনুযায়ী তার চাকরি পরিচালিত হবে।
দেশের অর্থনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট বা প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, মুদ্রানীতি এবং ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও পরিচালনা পর্ষদকে নীতিগত দিকনির্দেশনা দেন।
ড. আক্তার হোসেন একাধারে প্রথিতযশা শিক্ষক, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ। তার পুরো নাম আখন্দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) (১৯৭৮) ও স্নাতকোত্তর (১৯৮০) ডিগ্রি লাভ করেন।
উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে যথাক্রমে সম্মানসহ এম এ ও অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক মডেলিং’, যা পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পেমেন্ট ব্যালান্স’ শীর্ষক গ্রন্থ হিসেবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।
ড. হোসেন প্রায় ৩০ বছর অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং ২০২০ সালে সেখানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ২০২৪ সালে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সিঙ্গাপুর আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে তিনি এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠ্যসামগ্রী তৈরি করেন।
২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন এবং সেখানেই নীতি–ভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমের সূচনা করেন। তিনি গবেষণা বিভাগকে সক্রিয় করতে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করেন।
ড. আক্তার হোসেন থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অতিথি গবেষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং, মুদ্রানীতি এবং বাংলাদেশসহ এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক নীতি। তার রচিত গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ও মুদ্রানীতি’, ‘ইন্দোনেশিয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতি ও মুদ্রানীতির ইস্যুসমূহ’ প্রভৃতি। তিনি ৮৭টির বেশি গবেষণাপত্র স্বীকৃত অর্থনৈতিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশ করেছেন এবং ২৭টি অধ্যায় যৌথ গ্রন্থে লিখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ড. আক্তার হোসেন নিলুফার ইয়াসমিন হোসেনের সঙ্গে বিবাহিত এবং তাদের এক পুত্র ও তিন কন্যা রয়েছে। তাদের সন্তানেরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, যদিও কেউই অর্থনীতিবিদ নন। তিনি রাজনীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখলেও, সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে দরিদ্রবান্ধব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষে নীতিতে সহানুভূতিশীল। তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রক্ষণশীল হলেও নীতিগতভাবে সহনশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি সামষ্টিক অর্থনীতি ও মুদ্রানীতির ওপর গবেষণা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেবেন। তার গবেষণা অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে নতুন গতিশীলতা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।