দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের অভিজাত এলাকায় একটি জমকালো দোতলা বাড়ি। বাইরে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেটযুক্ত চারটি গাড়ি এবং একটি নেমপ্লেটে লেখা ‘গ্র্যান্ড ডুচি অব ওয়েস্টার্কটিকা’ ও ‘এইচইএইচভি জৈন অনারারি কনসাল’—এই বিবরণগুলোই বলে দেয়, এটি একটি দূতাবাস। কিন্তু আসল নয়, ভুয়া। উত্তর প্রদেশের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) সম্প্রতি এই ভুয়া দূতাবাসটি চিহ্নিত করেছে। এরপরেই হর্ষবর্ধন জৈন নামের এক ব্যক্তির প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে।
আটক হর্ষবর্ধন জৈনের বিরুদ্ধে বিদেশে চাকরির লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ এবং হাওয়ালার মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কূটনৈতিক নথি জাল করার অভিযোগ উঠেছে। এসটিএফ কর্মকর্তারা তাঁর কাছ থেকে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেটযুক্ত গাড়ি, ১২টি মাইক্রো নেশনের কূটনৈতিক পাসপোর্ট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাম্পযুক্ত নথি, ৩৪টি দেশের স্ট্যাম্প, নগদ ৪৪ লাখ টাকা, বিদেশি মুদ্রা, ১৮টি কূটনৈতিক নম্বরপ্লেট এবং একটি বিলাসবহুল ঘড়ির সংগ্রহ উদ্ধার করেছেন।
জৈন তাঁর অবৈধ কার্যক্রম চালানোর জন্য একটি নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। তিনি গাজিয়াবাদের একটি ভাড়া করা বাড়ি থেকে এই দূতাবাস চালাতেন। এই ভবনের বাইরে ভারত ও ওয়েস্টার্কটিকার পতাকা উড়ত। এই বিলাসবহুল বাড়ির বাইরে অডি ও মার্সিডিজের মতো বিলাসবহুল গাড়ি পার্ক করা থাকত, যেগুলোতে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেট লাগানো ছিল। জৈনের অফিসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে তাঁর সম্পাদিত ছবি দেখা গেছে, যা দেখে তাঁকে একজন প্রভাবশালী কূটনীতিক মনে হতো। প্রসঙ্গত, ওয়েস্টার্কটিকা অ্যান্টার্কটিকার একটি মাইক্রো নেশন, যা বিশ্বের কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত নয়।
তদন্তকারীদের মতে, জৈন এই ভুয়া দূতাবাসকে নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করতেন এবং তারপর বিদেশে চাকরির লোভ দেখিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলতেন। তদন্তে জানা গেছে, এই ভুয়া দূতাবাস ২০১৭ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে। জৈন লোকদেখানোর জন্য দূতাবাসের বাইরে ‘ভান্ডারা’সহ (কমিউনিটি ভোজ) বিভিন্ন দাতব্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
আটকের পর জানা গেছে, ২০১১ সালে জৈনের বিরুদ্ধে একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে পুলিশ মামলা করেছিল। তদন্তকারীরা জৈনের এমন ছবিও খুঁজে পেয়েছেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বিতর্কিত ‘গডম্যান’ চন্দ্রস্বামী এবং সৌদি অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগির ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
চন্দ্রস্বামী ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে একজন স্বঘোষিত গডম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হতো—পিভি নরসিমা রাও, চন্দ্র শেখর ও ভিপি সিং। আর্থিক অনিয়মের জন্য তিনি পুলিশের নজরে আসেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। সে সময় তাঁর আশ্রমে তল্লাশি চালিয়ে খাশোগির সঙ্গে তাঁর লেনদেনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। চন্দ্রস্বামীকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অর্থায়নেরও অভিযোগ করা হয়েছিল। জৈনের এই ধরনের কুখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংযোগ তাঁর ভয়ংকর অতীতের দিকেই ইঙ্গিত করে।
গাজিয়াবাদের ভুয়া দূতাবাসের বাইরে একটি নেমপ্লেটে জৈনকে ‘এইচইএইচভি জৈন, কনসাল-জেনারেল অব দ্য গ্র্যান্ড ডুচি অব ওয়েস্টার্কটিকা’ হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়েছিল। ইউপি এসটিএফ ভুয়া দূতাবাসটি ধরার কয়েক দিন আগে ওয়েস্টার্কটিকার অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেল তাদের নয়াদিল্লির কনস্যুলেট জেনারেলের ছবি শেয়ার করেছিল। ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘ব্যারন এইচভি জৈন দ্বারা পরিচালিত, ওয়েস্টার্কটিকার নয়াদিল্লির কনস্যুলেট জেনারেল ২০১৭ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ভারতে ওয়েস্টার্কটিকার স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা ছাড়াও ব্যারন জৈন বছরে পাঁচবার স্থানীয় জনগণকে খাবার বিতরণ করেন, যেখানে ১ হাজারের বেশি অভাবী মানুষকে সেবা দেওয়া হয়।’ ছবিতে গাজিয়াবাদের ভবন ও জৈনের আয়োজিত একটি ‘ভান্ডারা’র ছবি শেয়ার করা হয়েছিল।
‘ওয়েস্টার্কটিকা’ আসলে কী?
ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরি নামের একজন মার্কিন নৌ কর্মকর্তা ২০০১ সালে ‘ওয়েস্টার্কটিকা’ নামের একটি মাইক্রো নেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি নিজেকে এর গ্র্যান্ড ডিউক নিযুক্ত করেন। অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ওয়েস্টার্কটিকার আয়তন ৬ লাখ ২০ হাজার বর্গমাইল। ম্যাকহেনরি অ্যান্টার্কটিক চুক্তির মাধ্যমে নিজেকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি চালু করেন জাতীয় পতাকা ও মুদ্রা। তিনি দাবি করেন, সেখানে ২০০০ বাসিন্দারও বসবাস। তবে বাস্তবে সেখানে কেউ স্থায়ীভাবে থাকেন না।
এই অস্বীকৃত অঞ্চলকেই লক্ষ্য করে ভারতের মাটিতে তৈরি হয় হর্ষবর্ধনের ভুয়া রাষ্ট্রদূত নাটক। প্রশ্ন উঠছে, এত দিন কীভাবে প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলছিল এই আয়োজন? নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দিক থেকেও এই ঘটনা গভীর উদ্বেগের।
এফপি/টিএ