সবার আগে রাষ্ট্রের ৩ প্রধান অঙ্গের সমস্যার সমাধান করতে হবে: আসিফ নজরুল

কেবল আইন পরিবর্তন করে হবে না বরং বাংলাদেশে একটি মানবাধিকারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সবার আগে রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ সংস্কার করা দরকার উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘আগে এই তিনটা অঙ্গের সমস্যা সমাধান করতে হবে। আসল জায়গাতে হাত দিতে হয়।’

শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির ১১তম কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন।

আইন উপদেষ্ট বলেন, সবার আগে রাষ্ট্রের তিন বিভাগকে ঠিক করা দরকার। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এসব সমস্যা রেখে তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে কোনো লাভ হবে না। মানবাধিকারের বিষয়ে সবার উপলব্ধি ও আত্মশুদ্ধি লাগবে। আমাদের আগে আত্মসমালোচনা করতে হবে। এগুলোর সঙ্গে যখন আমরা আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন করব, তখন একটা সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আসতে পারে।

অনুষ্ঠানের আয়োজক হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) চেয়ারপারসন শাহজাদা আল আমিনের সভাপতিত্বে এর প্রধান উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় (ইউএনআরসিও) বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ একরামুল হক, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বক্তব্য দেন।

আইন উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে সেরা সময় কেটেছে ১৯৯১ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত। কারণ, তখন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল। এটি থাকলে জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে। তখন দেশ ভালোর দিকে এগিয়েছে। আমাদের দলগুলোর প্রত্যেকের তো সমস্যা আছে। কোনো দল যখন চিন্তা করে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাব, তখন ভয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কম করে। কোনো দলের ক্ষমতা হারানোর ভয় চলে গেলে তারা দানবে পরিণত হয়।

যেটা আমরা বিগত আওয়ামী শাসনামল দেখলে বুঝতে পারি। যার কারণে এক হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু হয়ে যেতে হয়েছে। কত কঠিন ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের আশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকতে হবে।

আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। কিন্তু সেটি হঠাৎ করেই হবে না। ক্রমান্বয়ে আমরা ভালোর দিকে এগোব। ভালো মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে যাব।

এ জন্য মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি আগামী তিন-চারটা নির্বাচন যদি সঠিকভাবে করতে পারি, আইনগত প্রশাসনিক সংস্কার যদি সঠিকভাবে চলে, সবার মধ্যে মানবাধিকার চর্চার অনুশীলনটা যদি গড়ে ওঠে, তাহলেই আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সময়ে শ্রমিকদের অধিকার ও পার্বত্য অঞ্চলের জন্য কাজ করছিলেন বলেই মাইকেল চাকমাকে তুলে নেওয়া হলো। কী করে জুলাই হত্যাকা- এবং এর আগের সময়ের হত্যার বিচার পাব, আমাদের তা ভাবতে হবে। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

সেমিনারে ঢাবির আইন অনুষদের ডিন ড. মুহম্মদ একরামুল হক বলেন, কাগজে অনেক কথা লেখা থাকে। আমরা চাই যথাযথ বাস্তবায়ন।

মানবাধিকার যদি লঙ্ঘন হয় তাহলে বিচার হবে আদালতে। কিন্তু আদালতকে যদি আমি ফ্যাসিজমের (স্বৈরাচারের) একটা অংশ করে ফেলি তাহলে আমি সংবিধানে যতই ভালো কথা লিখি, সেটি কোনো দিন হবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্টের (মানবাধিকার প্রয়োগ) জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা বিশাল ভূমিকা আছে।

তাদের বলতে হবে যে আমি কোনো দলের দাস হিসেবে কাজ করব না, আমি আইন অনুযায়ী চলব। ড. মুহম্মদ একরামুল হক আরও বলেন, ২০২৪ সালে অথরিটারিয়ান রেজিম (কর্তৃত্ববাদী শাসন) পতনের পর দেশের সামনে বিরল এক মোমেন্টাম এসেছে। এখন সময় দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী গভর্নেন্সে (সরকার) জবাবদিহি ও সংস্কার আনার। এসবের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

সেমিনারে আওয়ামী শাসনামলে গুম হওয়া আহমেদ বিন কাশেম ও মাইকেল চাকমা, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত দুই জুলাইযোদ্ধা এবং জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ নাইমা সুলতানার ও শাহরিয়ার খানের মা বক্তব্য রাখেন।

শহীদ শাহরিয়ার খানের মা সানজিদা খান বলেন, ‘আমরা এমন রাষ্ট্রে বাস করি যেখানে প্রতিটা ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি আমার সন্তানের বুকে বিদ্ধ হয়েছে, আমার দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী আমার সন্তানের ঘাতক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের সন্তানেরা রাজপথে নেমেছিল, সেখানেও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ হয়তো নেই যে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ওই দেশের সাধারণ মানুষের ঘাতক।’

মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমাকে তুলে নেওয়ার পর আমার পরিবার, মানবাধিকারকর্মীসহ অনেকে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছেন।একপর্যায়ে আমার পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মারা যান। তারা (পরিবার) একসময় আমারও শেষকৃত্য করে নেয়। একটা পরিবার কতটুকু আশাহীন হলে শেষকৃত্য করে নেয়! তিনি বলেন, আমরা সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছি।

কিন্তু এখনো প্রশ্ন রয়ে যায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কেমন হবে। এই বাংলাদেশে নানা জাতির বর্ণের মানুষ বাস করি, আমরা যেন এক হয়ে বাস করতে পারি। আমি আশাবাদী, আমি আমার ন্যায্য অধিকার আদায়ের যে লড়াই, সেই লড়াই এখনো চালু রেখেছি।

এমআর    

Share this news on:

সর্বশেষ

img
অন্তর্জালে অমির ‘১২ মাস’, নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন অমি Nov 02, 2025
img
‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে বিএনপি সংস্কারবিরোধী অবস্থান নিয়েছে : সাদিক কায়েম Nov 02, 2025
img
কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত : রোকন উদ্দীন Nov 02, 2025
img
নিকোলের সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর স্বীকার করলেন ইয়ামাল, দাবি স্প্যানিশ সাংবাদিকের Nov 01, 2025
img
সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করায় ঐকমত্য কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন Nov 01, 2025
img
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আ. লীগের ঝটিকা মিছিল, গ্রেপ্তার ১৩ Nov 01, 2025
img
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মোতায়েন থাকবে যৌথ বাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য Nov 01, 2025
img
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আ. লীগের প্রভাব ছিল : শামীম হায়দার Nov 01, 2025
img
সকাল ৯টার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের ১১ জেলায় ঝড়ের আভাস Nov 01, 2025
img
কেনিয়ায় ভূমিধসে প্রাণ গেল অন্তত ১৩ জনের Nov 01, 2025
img
বাহরাইনে একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 01, 2025
img
আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস Nov 01, 2025
img
পশ্চিমা প্রভাবেই আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে : রনি Nov 01, 2025
ব্ল্যাক ক্যাপসের আধিপত্য, ইংল্যান্ডের ব্যাটিং বিপর্যয় Nov 01, 2025
গুপ্ত রাজনীতি প্রসঙ্গে যা বললেন ছাত্রশিবির সভাপতি Nov 01, 2025
img
নভেম্বরের শেষভাগে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান : এম এ মালিক Nov 01, 2025
img
মুম্বাইয়ে রাজকীয় জন্মদিন উদযাপন শুরু শাহরুখের Nov 01, 2025
img
পেদ্রির চোটে বিস্মিত বার্সেলোনার কোচ Nov 01, 2025
img
রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীরে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে Nov 01, 2025
img
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ Nov 01, 2025