নয়া ন্যাটো গঠনের ছক কষছে ইরান, সঙ্গে আছে চীন-রাশিয়া

এক সময় বৈশ্বিক নিরাপত্তা চুক্তির আলোচনা কিংবা স্বাক্ষর মানেই ছিল ব্রাসেলস বা ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক টেবিল। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন যদি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চুক্তি হয় বেইজিংয়ে, আর সেই আলোচনায় ইরানকেও দেখা যায়- তবে বিষয়টি আর অতিরঞ্জিত কল্পনা নয়, বরং বাস্তবতার সম্ভাব্য চিত্র।

গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ইরান স্পষ্ট করেছে যে, তারা এসসিওকে আর কেবল আঞ্চলিক মঞ্চ হিসেবে দেখছে না, বরং এটিকে ন্যাটোর বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে তেহরান ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা পশ্চিমনির্ভর পুরনো ব্যবস্থার চেয়ে নতুন ইউরেশীয় ব্যবস্থার দিকেই বেশি আগ্রহী।

সম্মেলনে ইউরেশীয় দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার দৃঢ়তা চোখে পড়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন, যা মস্কো-বেইজিং জোটের শক্ত অবস্থানকে তুলে ধরে। বৈঠকের ফাঁকে লাভরভ চীন, পাকিস্তান, ভারত ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও করেন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে তাঁর বৈঠকে পারমাণবিক ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধান ও পারস্পরিক কৌশলগত সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হয়।

এসসিও প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আরাঘচি বলেন, এই জোট কেবল ‘প্রতীকী নয়’, এটি পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারার এক ‘কার্যকর একটি উপায়’ হতে পারে। ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপটে এসসিওর সমর্থনকে ইরান গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করে।

অনেকে ধারণা করেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান কিংবা ভারত-চীনের উত্তেজনার কারণে এসসিও অচল হয়ে পড়বে। কিন্তু ভারত সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় এবং জোটের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।

ন্যাটোর মতো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বনির্ভর নয় এসসিও, এই জোটে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ নিয়েও একত্রে কাজ করতে পারছে। এই নমনীয়তাই এটিকে ভিন্ন করে তুলেছে।

রাশিয়া এসসিওকে ইউরেশীয় কৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখছে। তারা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে চীনের সংযোগস্থল হয়ে উঠতে চায়, আর ইরানের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

এসসিও সম্মেলনে আরাঘচি শুধু সমালোচনাতেই থেমে থাকেননি। তিনি এসসিওকে আরও কার্যকর করার জন্য কিছু বাস্তব প্রস্তাবও দেন। এর মধ্যে রয়েছে-
বাইরের আগ্রাসন, নাশকতা ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় একটি যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ষড়যন্ত্র ও গোপন হামলার দলিল সংরক্ষণে স্থায়ী একটি সমন্বয় কাঠামো
একতরফা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় ‘সাংহাই স্যাংশনস রেজিস্ট্যান্স সেন্টার’
গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার জন্য সাংহাই সিকিউরিটি ফোরাম
সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম পর্যায়ে সহযোগিতা বাড়িয়ে তথ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা

এসব কোনো অলঙ্কারিক বক্তব্য নয়। ইরান আসলে একটি নতুন নিরাপত্তা দর্শন দাঁড় করাচ্ছে, যেখানে বহুপাক্ষিকতা, যৌথ প্রতিরক্ষা ও তথাকথিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ মোকাবেলার প্রস্তুতি আছে।

ন্যাটো চলে আমেরিকান নেতৃত্বাধীন কড়াকড়ি কাঠামোতে। এর বিপরীতে এসসিওতে রয়েছে সার্বভৌমত্ব, সমতা ও সভ্যতাগত বৈচিত্র্য। এসসিওর সদস্যরা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা ও বিপুল শিল্প-সম্পদকে প্রতিনিধিত্ব করে। ইরান এখন পরিষ্কারভাবে বোঝাতে চাইছে যে, এসসিও কেবল একটা আশ্রয় নয়, বরং নতুন একটি বৈশ্বিক যুক্তির ক্ষেত্র। এখানে নির্ভরতার নয়, কৌশলগত স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে পথচলার সুযোগ আছে।

ইরানের প্রস্তাব আসার কিছু দিনের মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নতুন করে আটজন ব্যক্তি ও একটি ইরানি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কারণ হিসেবে বলা হয় ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ অথচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। এই আচরণই ইরানের বক্তব্যকে প্রমাণ করে দেয় যে, বর্তমান ‘নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থা’ আসলে নিয়ম নয়, ক্ষমতার ভিত্তিতে চলে। তাই ইরানের মতে, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন নিজেদের শর্তে গড়া বহুপাক্ষিক ঐক্য।

ইরান যে শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য সুপরিকল্পিত পথেই এগোচ্ছে- তা এবার পরিষ্কার। তারা এসসিওকে একটি শক্তিশালী জোটে পরিণত করতে চায়, যেখানে একটি নির্দিষ্ট শক্তিধর ব্লকের কর্তৃত্ব থাকবে না। বরং, থাকবে পরস্পর সহযোগিতা, নিজস্ব শর্তে সমতা ও যৌথ নিরাপত্তা কাঠামো।

আর যদি এসসিও ইরানের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের দিকে এগোয়- তাহলে হয়তো আমরা ২১শ শতকের প্রথম প্রকৃত বিকল্প নিরাপত্তা জোটের জন্ম দেখতে পারব। এই পরিবর্তনকে পশ্চিমা বিশ্ব এখনো পাত্তা না-ও দিতে পারে। কিন্তু ইউরেশিয়ায়, নতুন যুগের খসড়া ইতিমধ্যেই লেখা শুরু হয়ে গেছে- এবং সেটা অবশ্যই ‘ইংরেজিতে’ নয়।

সূত্র: আরটি

কেএন/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img

সাদিক কায়েম

জুবায়ের ও সর্ব মিত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে কালচারাল ফ্যাসিস্টরা Nov 06, 2025
img
ভার্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে জয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম হাশমির Nov 06, 2025
img
বড় বাজেটের ভিড়ে ‘দ্য তাজ স্টোরি'র বাজিমাত Nov 06, 2025
img
রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি ‘ভারতের রোনালদো-মেসি' : রশিদ লতিফ Nov 06, 2025
img
অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার দল নিয়ে সমালোচনা সাবেক অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর Nov 06, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Nov 06, 2025
নিউইয়র্কে নতুন ইতিহাস, জেন-জি ফার্স্ট লেডি রামা দুওয়াজি Nov 06, 2025
সিলেট-৫ আসনে ৩০ বছরের মধ্যে প্রার্থী নেই বিএনপির Nov 06, 2025
মনোনয়ন চাপে বিএনপি, বদল হতে পারে প্রার্থী তালিকা Nov 06, 2025
রাষ্ট্র সংস্কারের জায়গায় ফেল হলে চুপ থাকবো না: এসএম ফরহাদ Nov 06, 2025
আইনি নোটিশের পরও সমাধান হয়নি, মামলা দায়ের Nov 06, 2025
জন্মদিনের পোস্টে মেয়েকে শাসন করলেন শাহরুখ Nov 06, 2025
শাকিবের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যাপিটালস এবারও হট ফেভারিট Nov 06, 2025
img
তারুণ্য নির্ভর ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই : জামায়াত আমির Nov 06, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

হলান্ড ও ফোডেনের দুর্দান্ত গোল, ডর্টমুন্ডকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিল ম্যানচেস্টার সিটি Nov 06, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

ব্রুজের মাঠে কোনোমতে হার এড়াল বার্সেলোনা Nov 06, 2025
img
আজারবাইজানি ক্লাবের সাথে ড্র করে পয়েন্ট হারাল চেলসি Nov 06, 2025
img
বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন রেজা কিবরিয়া Nov 06, 2025
img
রিয়ালের বিপক্ষে ট্যাকলে শতভাগ সফল ছিলেন ব্র্যাডলি! Nov 06, 2025
img
নিরাশা আছে, কিন্তু আমি নিরাশার প্রচারক হবো না, বললেন সংগীতশিল্পী সায়ান Nov 06, 2025