বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে চীন, বিপাকে ভারত

চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করেছে, যা প্রতিবছর ব্রিটেনের সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে বলে দাবি করছে বেইজিং। তবে প্রতিবেশী ভারত এ বাঁধকে ‘জলযুদ্ধের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

গতকাল তিব্বতের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ‘শতাব্দীর প্রকল্প’ হিসেবে পরিচিত মোতু হাইড্রোপাওয়ার স্টেশনের নির্মাণ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং। প্রকল্পটিতে পাঁচটি বিশাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হবে, যেগুলো ইয়ারলাং জ্যাংপো নদীর এক বাঁকে বসানো হবে। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে সেখান দিয়ে পানি টারবাইনে প্রবাহিত করা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।

চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই বাঁধে ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১২৪ বিলিয়ন পাউন্ড) খরচ হবে এবং বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় থ্রি গর্জেস ড্যামের তুলনায় তিন গুণ বেশি।

তবে ইয়ারলাং জ্যাংপো নদীই ভারতীয় অরুণাচল প্রদেশে ঢুকে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্র নামে এবং পরে বাংলাদেশে যমুনা নদীতে পরিণত হয়। এই নদীগুলো দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল ও উর্বর অঞ্চলের জীবনরেখা হিসেবে পরিচিত।

ভারতের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এই সুপার-ড্যাম চীনের হাতে এমন একটি ক্ষমতা তুলে দেবে যার মাধ্যমে তারা ইচ্ছেমতো পানি আটকে রাখতে বা হঠাৎ করে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি করতে পারবে।

অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেন, ‘বাঁধটি চালু হলে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্র নদী অনেকটাই শুকিয়ে যেতে পারে। এটি আমাদের জীবিকার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি।’

তিনি আরও বলেন, ‘চীনকে বিশ্বাস করা যায় না। কেউ জানে না তারা কী করতে পারে। ধরুন, তারা হঠাৎ বিশাল পরিমাণ পানি ছেড়ে দিল তাহলে সিয়াং নদী তীরবর্তী পুরো অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ, সম্পত্তি, কৃষিজমি সব কিছুই হারিয়ে যাবে।’

২০১৭ সালে সিয়াং নদীর পানির মান খারাপ হওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইয়ারলাং জ্যাংপো নদী বাঁধ নির্মাণে তাদের বৈধ অধিকার রয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘চীন কখনও নিজের স্বার্থে প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে না। আমরা নিচের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করব এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বাড়াব।’

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ইনস্টিটিউট ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭ শতাংশ জনসংখ্যা ভারতে বাস করলেও তাদের হাতে রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ মিঠা পানির উৎস।



২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার লোউই ইনস্টিটিউট বলেছিল, ‘তিব্বতের নদীগুলোর ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত ভারতের অর্থনীতিকে পেছন থেকে চেপে ধরার মতো।’ একই বক্তব্য দেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ নীরজ সিং মানহাস, তিনি বলেন, ‘চীন যেকোনো সময় এই পানিকে যুদ্ধের অস্ত্র বানিয়ে ব্লক করতে পারে বা দিক পরিবর্তন করে দিতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্যও বিশুদ্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন পানির জোগান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় পানির নিয়ন্ত্রণ মানে শুধু কৃষি নয়, ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতিকেই জিম্মি করা সম্ভব।

ভারতের কৌশল বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির ভাষায়, ‘জল-যুদ্ধ এখন আধুনিক যুদ্ধনীতির অংশ। এই ধরণের সুপার-ড্যামগুলো চীনকে উপরের দিকে বসে নিচের দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে।’

চেলানি আরও সতর্ক করেন, তিব্বত অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ হওয়ায় এত বড় বাঁধ তৈরি করাটা প্রকৃত অর্থে একটি ‘টাইম বোমা’র মতো।

উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এই চুক্তির অধীনে ভারত পাকিস্তানে প্রবাহমান ইন্দাস নদীর পানি সরবরাহ করতে বাধ্য ছিল। ফলে পাকিস্তান এটিকে ‘অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে দেখে।

সেন্ট গ্যালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মনালি কুমার বলেন, ‘এই পদক্ষেপ প্রতিবেশী দেশগুলোকে সতর্ক করে দেবে, কারণ এটি একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেখানে পানির মতো একটি মৌলিক সম্পদও যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।’

বিশ্বজুড়ে জলসম্পদকে কেন্দ্র করে সংঘাত ২০২৩ সালে ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে বলে জানায় প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট। কিন্তু এখনও আন্তর্জাতিকভাবে জলসম্পদকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে গণ্য করা হয় না, বরং পরিবেশ ও উন্নয়ন ইস্যু হিসেবেই দেখা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন থাকা উচিত। জেনেভা কনভেনশনের মতো চুক্তিতে এটি ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

এর আগে চীনের থ্রি গর্জেস ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পে ১৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল। পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন, মোতু ড্যামের ক্ষেত্রেও এমন দুর্যোগ অনিবার্য।

দার্জিলিংয়ের তিব্বত পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ টেম্পা গিয়ালতসেন জামলহা বলেন, ‘তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং বসতি চরম হুমকির মুখে পড়বে। স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা হবে এবং বাইরে থেকে হান চীনা জনগোষ্ঠীর আগমন ধীরে ধীরে স্থায়ী দখলদারিতে পরিণত হতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রের স্টিমসন সেন্টারের গবেষক ব্রায়ান আইলার বলেন, ‘এত বড় বাঁধ নির্মাণের ফলে মাছের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে, এবং নদীর সঙ্গে আসা পলি নিচের ভূমিকে উর্বর করে যে চক্র সৃষ্টি করত তাও ভেঙে পড়বে।’

পিএ/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট নতুন ব্যাপার না : সারোয়ার তুষার Nov 26, 2025
img
আমি আবেগপ্রবণ, একা বসে কেঁদেছি: নুসরাত জাহান Nov 26, 2025
img
তৃতীয়বার একসঙ্গে পর্দায় আসছেন তামান্না ও অজয় Nov 26, 2025
img
আমাকে নিয়ে নোংরামি করিয়েন না, প্লিজ : খাদিজাতুল কুবরা Nov 26, 2025
img
হুমা কুরেশির স্পষ্ট বক্তব্যে নতুন আলোচনার ঝড় Nov 26, 2025
img
কঠিন মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসী থাকার বার্তা বচ্চনের Nov 26, 2025
img
শুধুমাত্র নিজের কাজের প্রতিফলন গুরুত্বপূর্ণ: আনুশকা শর্মা Nov 26, 2025
img
জীবনের বাধা পার করার প্রেরণা দিলেন শাহরুখ খান Nov 26, 2025
img
প্রতিকেন্দ্রে নির্ধারিত সংখ্যায় সেনা মোতায়েন সম্ভব নয়: সিইসি Nov 26, 2025
img
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, তবে ভোটের আগে উন্নতি হবে: সিইসি Nov 26, 2025
img
বিয়ের প্রশ্নে খোলামেলা স্বীকারোক্তি দিলেন শ্রীলীলা Nov 26, 2025
img
তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভালো হবে : সিইসি Nov 26, 2025
img
প্রতিভাই প্রকৃত সৌন্দর্য: রণবীর সিং Nov 26, 2025
img
অরুণাচল ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশ, চীনের দাবির পর জানালো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় Nov 26, 2025
img
৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই মহাবিপদের আশঙ্কা , রেড জোনে দেশের বড় এক অঞ্চল Nov 26, 2025
img
‘ভারতকে পায়ের তলায় রাখতে চেয়েছিলাম’ Nov 26, 2025
img
নবম থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শহরে পরিণত হলো ঢাকা Nov 26, 2025
img
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের করাচির মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু! Nov 26, 2025
img
হেরে যাওয়া নয়, সাহসী হওয়া জরুরি: হৃত্বিক রোশান Nov 26, 2025
img
বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাকে সম্মানসূচক পদক প্রদান করলো ফরাসি সরকার Nov 26, 2025