এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড, আওয়ামী সরকারের কাজে বিস্মিত জাতিসংঘ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাত্র এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড করা হয়। রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন ব্যক্তিদের স্পর্শকাতর কল রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ফাঁস করা হয়। আর এ কাজটি করেন জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র।

বিষয়টি সম্প্রতি অফিসিয়ালি জানানো হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে। এতে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে বলেও সূত্র জানায়।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক নীতিনির্ধারক বলেন, ক্ষমতার চেয়ার সুরক্ষা করতে আইন ও নীতির তোয়াক্কা না করে এসব ফোনকল রেকর্ড করা হয়। যারাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করেছে বা ভিন্নমত পোষণ করেছে তাদেরই ফোনকল রেকর্ড করা হতো।

এ নিয়ে একটি টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছে। যদি কোনো জরিপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এটা একটি বিশ্ব রেকর্ড। অন্য কোনো দেশে সরকারবিরোধীদের ফোনকল এভাবে রেকর্ড করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল ফাঁস করে তা বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপ রেকর্ডের সারাংশ গণভবন থেকে উদ্ধার হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরো জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যতবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল, তা জিয়াউল আহসানের নির্দেশে বন্ধ করা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার সময় ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালকের নির্দেশেই। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন। জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসি মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্তমানে বেশ কয়েকটি মামলায় আটক রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও তা মূলত পরিচালনা করত একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এখন চেষ্টা চলছে ওই সংস্থার কাছ থেকে এনটিএমসিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনার। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে এনটিএমসিকে যেন কেবলই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।

এদিকে দেশে নজরদারির যন্ত্রপাতি নিয়ে তদন্ত করতে সম্প্রতি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটির প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। কমিটি খতিয়ে দেখবে যন্ত্রপাতি কীভাবে, কোথা থেকে, কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে এবং কীভাবে এর ব্যবহার করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক নিয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘সারভাইল্যান্সের যন্ত্রপাতি বিগত সরকারের সময় কেউ বলছেন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে, কেউ বলছেন প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে। পুরো রিপোর্টে আমরা যা পড়েছি সেখানে পুরোপুরি স্পষ্টত গত স্বৈরাচারী সরকার বাংলাদেশের নাগরিকের নাগরিক অধিকার হরণের জন্য নজরদারির যন্ত্রপাতি, স্পাইওয়ার ব্যবহার করেছে। এই অবৈধ নজরদারি করার জন্য আমার-আপনার ন্যূনতম বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সংবিধানে যে গোপনীয়তার অধিকার দেওয়া হয়েছে সেটাকে তারা খর্ব করেছে।’

উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, এটা তদন্ত করার জন্য। তদন্ত করে কত টাকা দিয়ে এগুলো কেনা হয়েছে, কোথা থেকে এগুলো কেনা হয়েছে, যদিও রিপোর্টে বলা হয়েছে অনেক কিছু ইসরায়েল থেকে কেনা হয়েছে। এই পুরো বিষয়গুলো কমিটি খতিয়ে দেখবে। এই কমিটির প্রধান থাকবেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। ২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে ডিজিএফআই ভবনে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) গঠিত হয়। এনএমসি নিরলসভাবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে ল’ফুল ইন্টারসেপশন সহায়তা প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ সংঘটনের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এনএমসি পরিবর্তিত হয়ে ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংস্থাটি ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সাল থেকে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে।

এফপি/ এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ঝিনাইদহে গণঅধিকার পরিষদ নেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর Nov 09, 2025
img
দেবীদ্বারে ছাব্বির হত্যাচেষ্টা মামলায় আ. লীগের ৪ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Nov 09, 2025
img
গ্রেপ্তারের পর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিল স্বজনরা Nov 09, 2025
img
১৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ, মধ্যরাতে প্রজ্ঞাপন জারি Nov 09, 2025
img
ভাঙ্গায় থানা ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার ১ Nov 09, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে ইঞ্জিন বিকল, ট্রলারসহ ১৩ জেলে উদ্ধার Nov 09, 2025
img
নির্বাচন নিয়ে একটি পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার চেষ্টা করছে : ব্যারিস্টার অসীম Nov 09, 2025
img
সালমান এখনও আমাকে হুমকি দিচ্ছেন, অভিনেত্রীর অভিযোগ Nov 09, 2025
img
বরিশালে ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ২ জনের Nov 08, 2025
img
দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী দেব না : নুর Nov 08, 2025
img
১৩ নভেম্বরের লকডাউন কর্মসূচি দেওয়া পাগলের প্রলাপ: সালাহউদ্দিন Nov 08, 2025
ইসলামের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা | ইসলামিক জ্ঞান Nov 08, 2025
img
ধানের শীষের বিজয় মানেই উন্নয়ন : চৌধুরী নায়াব ইউসুফ Nov 08, 2025
আনুশকা শর্মা মুখ্য ভূমিকায়, বড় পর্দায় ফেরার প্রস্তুতি Nov 08, 2025
অশালীন নাচে মালাইকা, সমালোচনার ঝড়ে হানি সিংও Nov 08, 2025
প্রিয়াঙ্কা-সোনমের শুভেচ্ছায় ভাসলেন ক্যাটরিনা Nov 08, 2025
অভিষেক শর্মার আগ্রাসী ব্যাটিং, টিম ডেভিডকে ছাড়িয়ে বিশ্বরেকর্ড Nov 08, 2025
ইউরোপে হারের পর লা লিগায় ঘুরে দাঁড়াতে প্রস্তুত রিয়াল Nov 08, 2025
আইসিসি নিয়ম বদলে দিচ্ছে অলিম্পিকের ক্রিকেটের চেহারা Nov 08, 2025
এই গণভোটের মধ্য দিয়ে কি আইন প্রণীত হয়ে যাবে? : সালাহউদ্দিন আহমেদ Nov 08, 2025