আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বদলাতে বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভন দেখানো হয় চিকিৎসককে

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। রংপুরের এ মেধাবী শিক্ষার্থীর তাজা রক্ত ঝরতেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। কিন্তু আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বদলাতে চাপ দিতে থাকেন আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড ভ্রমণের প্রলোভনও দেখানো হয়। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জমা দেন এ হত্যাকাণ্ডের সত্য প্রতিবেদন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজের জবানবন্দিতে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরেন ডা. রাজিবুল ইসলাম। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আজ সাক্ষ্য দেন এই চিকিৎসক। এদিন ১৮ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল।

জবানবন্দিতে ডা. রাজিবুল বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত আমি নিজেই করি। যথানিয়মে তার শরীরে পিলেট পাওয়া যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বহু পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে তিনি মারা গেছেন বলে আমি প্রতিবেদন দেই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদনটি দিলে পুনরায় তৈরি করতে বলা হয়। কেননা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করলে ওই প্রতিবেদনটি নেওয়া হয়নি। এরপর ভাষাগত পরিবর্তন করে আবারও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদনও নেননি তারা।

এভাবে তৃতীয় প্রতিবেদনও জমা দেন ডা. রাজিবুল ইসলাম। এভাবে একে একে পাঁচবার লিখতে হয় আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। চতুর্থবারের মতো দেওয়ার আগে ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই নিজের কক্ষে এই চিকিৎসককে ডেকে নেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মাহফুজুর রহমান। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন সিটি এসবির পুলিশ সুপার সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি চন্দন। আর কক্ষের বাইরে ছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআইসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা।

এই সাক্ষী বলেন, কক্ষে ডেকে নিয়ে তারা আমাকে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরির কথা উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে চাপ দেন। তাদের মনমতো না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে বলেও তারা জানান। একপর্যায়ে রাজি না হলে আমাকে দুই সপ্তাহের ছুটির প্রস্তাব দেন। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে ঘুরে আসার প্রলোভন দেখান। তারা বলেন- দুই সপ্তাহের ছুটি দিচ্ছি। থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে ঘুরে আসেন। তবু আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পরিবর্তন করে দিন।

জবাবে পাসপোর্ট নেই বলে জানান এই সাক্ষী। পরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলেন তারা। তখন এই চিকিৎসক বলেন, আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিলে ডাক্তার সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে বিশ্বের মানুষ।

এরপর স্বাচিপের সভাপতি ডা. চন্দন বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে চায়, সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখবো।

এত কিছুর পরও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি ডা. রাজিবুল ইসলাম। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ চতুর্থবার আমার দেওয়া প্রতিবেদনে ইনজুরির বর্ণনা ঠিক করলেও গানশট ইনজুরির কথা উল্লেখ করিনি। পিলেট ইনজুরিসহ অন্যান্য বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর তারা সেটি নিয়ে যান।

সাক্ষী বলেন, আমাকে অনবরত হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সত্য প্রতিবেদন দিয়েছি। আগে যে তিনটি প্রতিবেদন ফেরত দেওয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পেরেছি। এসব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ সময় আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশদানকারী, হত্যার সহায়তাকারীসহ জড়িত সবার বিচার চেয়েছেন শহিদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রাজিবুল।

কেএন/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিমানবন্দর রেলস্টেশনে এবার ককটেল বিস্ফোরণ Nov 16, 2025
img
তিনবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলেন মেসির সতীর্থ Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির মামলার রায় সোমবার Nov 16, 2025
img
রিয়াল মাদ্রিদকে বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিল বার্সেলোনা Nov 16, 2025
img

অনূর্ধ্ব ১৭ ফিফা বিশ্বকাপ

জার্মানির বিদায়, বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় নর্থ কোরিয়া-অস্ট্রিয়া Nov 16, 2025
img
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো মূল্যবোধ : মিঠুন চক্রবর্তী Nov 16, 2025
img
পিকচার আভি বাকি হ্যায়, বার্তা বলিউড তারকার Nov 16, 2025
img
ঢাকায় এসে পৌঁছেছে ভারতীয় ফুটবল দল Nov 16, 2025
img
আসলে শেখ হাসিনা আমার মায়ের মতো : বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী Nov 16, 2025
img
ছেলের সঙ্গে বাবার দূরত্বের কারণ খুঁজলেন সোহিনী Nov 16, 2025
img
সাবেক চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের দুই নেতা গ্রেপ্তার Nov 16, 2025
img
সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চুপ থাকা প্রয়োজন : অক্ষয় কুমার Nov 16, 2025
img
পরিবারই সত্যিকারের বন্ধু, মন্তব্য অভিনেত্রীর Nov 16, 2025
img
রাজধানীর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধে বাসে আগুন Nov 16, 2025
img
মা হওয়াই নারীর পূর্ণতা নয় : শাবানা আজমি Nov 16, 2025
img
দুর্নীতিতে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলকে জনগণ আর ভোট দেবে না: তাহের Nov 16, 2025
img
সেনেগালের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের জয়, গোল করলেন এস্তেভাও-ক্যাসেমিরো Nov 16, 2025
img
পুলিশের মনোবল আগের চেয়ে বেড়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
জানা গেল ২০২৬ সালের রোজা ও ঈদুল ফিতরের সম্ভাব্য তারিখ Nov 16, 2025
img
আল্লু অর্জুন ও রাজামৌলি: বড় পর্দার নতুন চমক Nov 16, 2025