বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। রোববার বিকালে তিনি বাড়ি থেকে বুয়েটের হলে ফেরেন। হলে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত আটটার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা।
তারা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখেন। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী আসেন। তারা আরেক দফা পেটান আবরারকে। একনাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টা নির্যাতনের করে তাকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এর আগে ৩ অক্টোবর বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেলের নেতৃত্বে সেই একই গ্রুপ আবরারসহ আরও ছয় থেকে সাত শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়েছিল। ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে তাদের ওপর মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল তখন।
সেই রাতে ঘটনাস্থলে থাকা একজন শিক্ষার্থী বলেন, তারা আমাদের কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর ফেসবুকে পোস্ট করা কয়েকটি স্ট্যাটাস নিয়ে জেরা করেন। তখন অবশ্য মারধর করেননি। তবে সামাজিকমাধ্যমে এমন কিছু না লিখতে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে ফেসবুকে কিছু লিখলে হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।
বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তুচ্ছ কারণে তাদের হল থেকে বের করে দেয়া ও র্যাগিং করা হয়। হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা অহরহ। গত বছরের ৭ আগস্ট রাসেলের নেতৃত্বাধীন কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের দাইয়ান নাফিসকে ব্যাপক মারধর করেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেয়ায় এই মারধর করা হয়েছে বলে তার এক সহপাঠী জানান। পরবর্তী সময়ে দাইয়ানকে চকবাজার থানায় হস্তান্তর করেন ছাত্রলীগের বরখাস্ত হওয়া সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি।
দাইয়ানকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রতিবাদ করায় একই রাতে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের ইহতেশামুল আজিমকেও নির্যাতন করে ছাত্রলীগ।
২ অক্টোবর হলের ২০২ নম্বর কক্ষে ডেকে ইহতেশামকে মারধর করেন রাসেল। এরপর তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন দাইয়ান ও ইহতেশাম।
মতিউর রহমান নামে এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সালাম না দেয়ায় সোহরাওর্দী হলের ৫১১ থেকে ১০১০ রুমে তাকে ডেকে নিয়ে যান ছাত্রলীগ কর্মী মুবাশ্বির শান্ত ও মাহাদি হাসান।
মতিউর রহমান বলেন, ‘কেন তাদের সালাম দিইনি, তারা আমাদের সেই প্রশ্ন করেন। জবাব দেয়ার সময় যখন ফিসফিস করছিলাম, তখন আরও দুই সহপাঠী ও আমাকে চরথাপ্পর মরেন ওই দুই ছাত্রলীগ কর্মী। আমি চিকিৎসকের কাছে গেলাম। ডাক্তার বললেন আমার কানের ভেতরে রক্ত ঝরেছে।’
পর দিন সোহরাওয়ার্দী হলের চত্বরে ১৮ ব্যাচের ২০ শিক্ষার্থীকে ডেকে পাঠায় শান্ত ও মাহাদি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্র বলেন, ‘সেখানে সিনিয়রদের শনাক্ত করতে নির্দেশ দেন মাহাদি। একজন বাদে সবাইকেই আমি শনাক্ত করি। এরপর যাকে শনাক্ত করতে পারিনি, তাকে থাপ্পর দিতে বলে আমাকে। কিন্তু আমি তার কথা মতো কাজ না করায়, মাহাদি আমাকে থাপ্পর দেন।’
অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন কিংবা মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতে ভয় পান শিক্ষার্থীরা।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, হয়রানির ভয়ে নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দাখিল করতে সাহস পান না। বিচার না পাওয়ার আতঙ্ক থেকে নির্যাতন সত্ত্বেও সবাই নীরব হয়ে যান বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
টাইমস/এসআই