‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত একটি গান: সাইমন জাকারিয়া

‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি একটি ঐতিহ্যের অংশ এবং এর স্বত্বাধিকারের দাবি করা যায় না। বাংলাদেশ টাইমসের সাথে এক সাক্ষাতকারে লোক সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক ও নাট্যকার সাইমন জাকারিয়া এ কথা জানান।

তিনি বাংলাদেশ টাইমসকে বলেন, “২০১৩ সালের ইউনেস্কো কনভেনশন অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ লোক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ বা সুরক্ষা প্রদান সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পরে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ঐতিহ্য এখনো গড়ে ওঠেনি কিংবা এই দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো বিশেষায়িত সংস্থাও নেই। তাই লোক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।”

তিনি বলেন, “যদি সরকারের এমন কোনো সেল থাকে যেখানে বাংলাদেশের লোক সঙ্গীত সংরক্ষিত থাকবে, তাহলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কেউ সেটির স্বত্বাধিকার দাবি করতে পারবে না। যে কেউ এই গানগুলি গাইতেই পারে, তবে অবশ্যই এর উৎস উল্লেখ করতে হবে।”

সাইমন জাকারিয়ার দেয়া তথ্য মতে, ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থের ৫৭৫ পৃষ্ঠায় সংকলিত একটি গানের সাথে সরলপুর ব্যান্ডের স্বত্বাধিকার দাবি করা গানটি অনেকাংশেই মিলে যায়। বিশেষত শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে এই মিল অনেক বেশি লক্ষণীয় বলে মনে করেন জাকারিয়া।

আলোচনার সুবিধার জন্য ‘বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থে সংকলিত গানটির প্রথম দুই লাইন উল্লেখ করা হলো:

“সর্ব জয় মঙ্গলা রাধে বিনোদিনী রায়।
বৃন্দাবন মন্দিরে গাইবো ঠাকুর কানাই।।”

অন্যদিকে সরলপুর ব্যান্ডের স্বত্বাধিকার দাবি করা গানে একইরকম দু’টি লাইন পাওয়া যায়:

“সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রায়।
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই।”

শুধু এই লাইন দু’টি নয়, গান দু’টির আরও অনেক অংশ এভাবেই মিলে যায়। যেমন সংকলিত গানটিতে রয়েছে:

“বেজার কেন হব, কানাই, বেজার কেন হব।
ভাল মন্দ দুটি কথা কাছে কাছে বলিব।”

অন্যদিকে সরলপুর ব্যান্ডের গাওয়া গানটিতে এই দু’টি লাইন একটু অন্যভাবে উল্লেখ আছে:

“বেজার কেনে হব, কানাই, বেজার কেনে হব,
ভাল মন্দ দু-চার কথা তোমারে জানাইবো।”

সাইমন জাকারিয়া বলেন, এ থেকেই বোঝা যায় যে গানটি একটি ঐতিহ্যের অংশ থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাংলার লোক সাহিত্য’ বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ঝাপান পর্বের একটি ছড়ার সাথেও গানটির সাদৃশ্য রয়েছে। এই বইয়ের ২১২-১৩ পৃষ্ঠায় এই গানটি আংশিক মুদ্রিত আছে:

“কোথায় পাইমু হাড়ি কলসী, কোথায় পাইমু দড়ী?
রাধে, তুমি হও যমুনার জল, আমি ডুইব্যা মরি।”

তিনি বলেন, “শুধু বিভিন্ন প্রকাশনায় এই গানের দৃষ্টান্ত রয়েছে এমনটা নয়, এছাড়াও গ্রামের গায়কদের কাছ থেকে সংগ্রহীত তাদের হাতে লেখা খাতা থেকেও এই গানের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাবনা থেকে আবিষ্কৃত শ্রী নেপাল চন্দ্র দাসের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতেও এই গানের দৃষ্টান্ত রয়েছে।”

নেপাল চন্দ্র দাসের বাঁশি চুড়ি কবিতার কিছু অংশ:

“… তোমার মত সুন্দর রাধে, পাইলো দিত বিয়া।।
আমার মত সুন্দর রাধে, কানাই যদি চাও।
গলেতে কলসী বেঁধে, যমুনাতে যাও।।
কোথায় পাবো হাঁড়ি কলসী, কোথায় পাব দড়ী।
তুমি হও যমুনার জল, আমি ডুবে মরি।।
এই কথাটা বলে রাঁধা, ঝলক দিয়ে যায়।
কানাইর হাতের মোহন বাঁশী, সর্প হয়ে যায়।।”

সরলপুর ব্যান্ডের স্বত্বাধিকার দাবি করা গানের সাথে নেপাল চন্দ্র দাসের এই গানটিও অনেকটাই হুবহু মিলে যায়। এই মিল অবশ্যই কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়, এর থেকে প্রমাণিত হয় যে গানটি বাংলার লোক সংস্কৃতিরই অংশ। যা অন্যায় ভাবে এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সরলপুর ব্যান্ড তাদের মৌলিক রচনা বলে দাবি করছে। এই গানের স্বত্বাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন জাকারিয়া।

তিনি বলেন, এই গানটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত একটি গান এবং লোক ঐতিহ্যের অংশ। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর মালিকানা দাবি করতে পারে না।

সাইমন জাকারিয়া মনে করেন, সরলপুর ব্যান্ডের ম্যানেজার আল-আমীন এক টিভি অনুষ্ঠানে এই গানটি একজন বাউলের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন বলে যে মন্তব্যটি করেছিলেন সেটিই সঠিক। তবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল সেই বাউল এবং তার স্ত্রীর নাম উল্লেখ করা।

তিনি বলেন, যদিও সরলপুর ব্যান্ড এই গানটির কপিরাইট নিয়েছে, কিন্তু এর কোনো বৈধ্যতা তাদের ছিলনা। এটি একটি লোকায়াত পর্বের গান, লীলা কীর্তনের আসরে এটি পরিবেশিত হয়।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামের একটি গানের স্বত্বাধিকার নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের কণ্ঠে গাওয়া গানটি ‘আইপিডিসি আমাদের গান’ ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হলে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।

বাংলা ব্যান্ড দল সরলপুর দাবি করে গানটির স্বত্বাধিকার সনদ তাদের কাছে রয়েছে এবং গানটি রচনা করেছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভোকালিস্ট তারিকুল ইসলাম তপন। অন্যদিকে গানটি মূলত লোক সঙ্গীত এমন পাল্টা দাবিও তোলেন অনেকে। ফলে স্বভাবতই গানটির উৎস নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

 

টাইমস/টিএইচ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের লক্ষ্য জানালেন সাকিব Apr 25, 2024
img
গাজায় ২০ জনকে জীবন্ত কবর দেয়ার অভিযোগ Apr 25, 2024
img
দীর্ঘ তাপপ্রবাহে রেকর্ড, কতদিন থাকবে জানাল অধিদপ্তর Apr 25, 2024
img
শিক্ষক নিয়োগ: পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে হাতে পৌঁছে যেত উত্তরপত্র Apr 25, 2024
img
বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে তাকালে আমরা লজ্জা পাই: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী Apr 25, 2024
img
রবিবার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারও চলবে ক্লাস Apr 25, 2024
img
এক দিনের ব্যবধানে আরও কমলো স্বর্ণের দাম Apr 25, 2024
img
চুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ Apr 25, 2024
img
যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া বিএনপি: কাদের Apr 25, 2024
img
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত শনিবার: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Apr 25, 2024