কিশোর মুয়াবিয়া: যার কারণে সিরিয়া যুদ্ধের শুরু

স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের নির্মম ও নিষ্ঠুর দুঃশাসনে অতিষ্ট সিরিয়ার জনগণ। তাদের বুকে তীব্র যন্ত্রণা, মনে চাপা ক্ষোভ। প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না কেউ। যেই প্রতিবাদ করতে গেছে, সেই তার হিংস্র থাবায় নিঃশেষ হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ছেলেটির নাম মুয়াবিয়া সিয়াসেহে। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। সিরিয়ার দারা শহরে সে বাস করত। একদিন সে ও তার বন্ধুরা মিলে স্থানীয় একটি স্কুলের দেয়ালে আসাদ সরকারবিরোধী স্লোগান লিখে ছড়িয়ে দেয়। এটা ছিল তার নিছক মনের চাপা ক্ষোভের একটি বহিঃপ্রকাশ। তখন সে কল্পনাও করতে পারেনি যে, তার এই একটি ছোটখাটো কাজ, একটি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দেবে।

সম্প্রতি আল-জাজিরার একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মে সেই কিশোরের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে যে, কিশোর মুয়াবিয়ার সেই ছোট উদ্যোগ থেকে ধীরে ধীরে আসাদবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর সে বিক্ষোভ থেকেই একপর্যায়ে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। যে গৃহ যুদ্ধ আজও অব্যাহত রয়েছে। আর কেউ এটাও জানেনা যে এর শেষ কোথায়?

তখন মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের জোয়ার বইছে। স্বৈরতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, ইয়মেন। এক সময় সে জোয়ারের ঢেউ লাগে সিরিয়ায়। সেদিন মুয়াবিয়া ও তার সঙ্গে এ কাজে সহযোগিতাকারী আরও তিনজন বন্ধু ছিল। তারা স্থানীয় একটি স্কুলের দেয়ালে আরবিতে লিখে- ‘It’s your turn, Doctor (Basher al-Assad).’

তারা জানায়, সেদিন কোন যুদ্ধ কিংবা আন্দোলন সংগ্রামের অংশ হিসেবে তারা এটা লিখেনি। কারণ সে সময় আসাদ সরকারের সম্পর্কে তাদের ভাল ধারণাও ছিল না। তারা তখনও জানত না যে, দশকের পর দশক বিরোধী মতাবলম্বীদের নির্মমভাবে নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভুতভাবে হত্যা করে আসছে আসাদ সরকারের গোপন পুলিশ বাহিনী। অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার ভয়ে দশকের পর দশক তাদের মা-বোনেরা রাস্তা-ঘাটে একা বের হতে পারে না। সেই সময় তারা টিভিতে আরব বসন্তের সংবাদগুলো দেখে।

আর কৌতূহল থেকেই তারা স্কুলের দেয়ালে আসাদের বিরুদ্ধে এই শ্লোগানটি লিখে। পরে পুলিশ মুয়াবিয়াসহ ২৩ জন কিশোরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ৪৫ দিন তারা আটক ছিল। তাদের প্রতি অত্যন্ত নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। তাদের মুক্তির দাবিতে সেদিন হাজার হাজার লোক দারা শহরের রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা যায়। একপর্যায়ে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র সিরিয়ায়। সেই থেকে যুদ্ধ শুরু। দীর্ঘ সাত বছর হতে চলেছে।আজও সে যুদ্ধ থামে নি।

২০১১ সাল থেকে চলা এই গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যে ৬-৭ লাখ লোক মারা গেছে। প্রায় ৭৬ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ৫১ লাখ লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, যার অর্ধেকই শিশু। ৭ লাখ লোক এখনও অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ৩ লাখের চেয়েও বেশি শিশু শরণার্থী হিসেবে জন্ম নিয়েছে। ২০ লাখেরও বেশি শিশু এখনও কোনো মানবিক সহায়তা পাচ্ছে না।

কিশোর মুয়াবিয়া আজ তরুণ। সে নিজেও আজ ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির’ একজন যোদ্ধা হিসেবে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অথচ একসময় সে আইএসআইএল, আল-নুসরা কিংবা অন্য কোন সন্ত্রাসী দলের সদস্য ছিল না। সে ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে আজ তার প্রিয় দারা শহরের রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি তছনছ হয়ে গেছে। চরম মূল্য দিতে হয়েছে তার পরিবারকে।

২০১৩ সালে বিমান হামলায় সে তার বাবাকে হারিয়েছে। এক সাক্ষাতকারে সে আল-জাজিরাকে জানিয়েছে, এ ভয়াবহ যুদ্ধের কথা সে
কল্পনাও করেনি। আর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য সে অনুতপ্ত। তারা এটা কখনও চায়নি। এরকম পরিণতি ঘটবে জানলে সে কখনো এটা লিখত না। সেই লিখাটা ছিল তার একটা মারাত্মক ভুল। এখন তাদের একটাই চাওয়া, সিরিয়ায় পরিবর্তন ও শান্তি।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: