আন্দোলনে হামলার বর্ণনা দিলেন ডিএমপি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম

মো. আশরাফুল ইসলাম। এসআই হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে। সেই সুবাদে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার সামনেই গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে হাতে অস্ত্র থাকলেও অবৈধ আদেশ মানেননি আশরাফুল। এজন্য শুনতে হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গালি। পেয়েছেন চাকরি যাওয়ার হুমকিও।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষীর ডায়াসে দাঁড়িয়ে দেওয়া এসআই আশরাফুল ইসলামের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব বর্ণনা। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৩৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি।

১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে পুলিশে যোগ দেন আশরাফুল। ২০০২ সালের ১৩ জুলাই থেকে ডিএমপিতে কর্মরত। ২০১৮ সালে এসআই (সশস্ত্র) হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।

জবানবন্দিতে আশরাফুল বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সঙ্গীয় এএসআই মুরাদ, নায়েক জসিম, কনস্টেবল মাহমুদুল, কনস্টেবল মেহেদী, কনস্টেবল নাসিরুল, কনস্টেবল মাহবুবসহ এক প্লাটুন ও এসআই হেলাল নিজের ফোর্সসহ এক প্লাটুন অর্থাৎ ৪০ জন অফিসার ও ফোর্স নিজ নিজ নামে অস্ত্র, গুলি, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ইত্যাদি সরঞ্জামাদিসহ মিরপুর পুলিশ লাইন থেকে নিয়ে ভোর ৪টায় রওনা হই। সকাল ৬টার পর জরুরি দায়িত্বের জন্য শাহবাগ থানায় পৌঁছাই আমরা। সেদিন ভোর ৫টায় ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও সকাল ৬টায় যুগ্ম-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী শাহবাগ থানায় আসেন বলে জানতে পারি।

থানায় এসে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের ওই দিনের আন্দোলন দমনে গুলি করাসহ অন্যান্য নির্দেশনা দিয়ে চলে যান তারা।

তিনি বলেন, ওই দিন আন্দোলনকারীদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। সকাল ৯টায় আমাদের দুই প্লাটুনসহ ডিএমপি থেকে আসা এক প্লাটুন, ১৩-এপিবিএনের এক প্লাটুন ও রাজারবাগ থেকে এক প্লাটুন নারী পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা দায়িত্ব নিয়ে ব্রিফ করেন রমনা জোনের তৎকালীন এডিসি শাহ আলম মোহাম্মদ আখতারুল ইসলাম। ব্রিফিং শেষে নারী পুলিশ ও ডিএমপি পুলিশের দুই প্লাটুন ছাড়া ৬০ থেকে ৬৫ জন পুলিশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছাই। আমাদের নেতৃত্ব দেন এডিসি আখতারুল স্যার, এসি ইমরুল স্যার ও আরশাদ স্যার। শহীদ মিনারে গিয়েই এসি ইমরুল স্যারসহ কয়েকজন মিলে কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

এই সাক্ষী আরও বলেন, এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে প্রিজনভ্যানে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়। পরে তার নির্দেশেনা অনুযায়ী এসি ইমরুল স্যার, আরশাদ স্যারসহ ১৫-২০ জন এপিবিএন সদস্য, ডিএমপির ১০-১৫ জন সদস্যের সঙ্গে আমি ও আমার সঙ্গীয় কনস্টেবল পিয়াস, আসিফ, আকাশ, নাসিরুলরা হেঁটে বেলা সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে চানখারপুলে পৌঁছাই।

ওই সময় মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে শাহবাগের দিকে যেতে চান বংশাল-চকবাজার এলাকা থেকে আসা হাজারও ছাত্র-জনতা। কিন্তু এডিসি আখতারুলের নির্দেশে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাসগান ও শটগান দিয়ে গুলি ছোড়া হয়। এপিবিএনকে দিয়ে শটগান ফায়ার করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়।

ওই সময় এডিসি আখতারুল স্যার আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে, তারা আন্দোলনকারীদের দিকে ফায়ার করে তাদের মেরে ফেল।’

তখন আমিসহ আরো কয়েকজন এই অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ আদেশ পালন না করলে স্যার অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন। তিনি আমাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোরা সরকারের বেতন-রেশন খাস না? গুলি করবি না কেন? তোদের চাকরি খেয়ে নেব।’ এরপরও আমি আমার পিস্তল দিয়ে ফায়ার করা থেকে বিরত থাকি। এরপর এডিসি আখতারুল স্যারের সরবরাহ করা অতিরিক্ত গুলি ব্যবহার করেন কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম।

স্যারের নির্দেশে ও দেখানোমতে রাস্তায় বসে চায়না রাইফেলে গুলি লোড করেন তিনি। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের টার্গেট করে বারবার ফায়ার করতে থাকেন।

সাক্ষী আরও জানান, এপিবিএনের একজন কনস্টেবলের হাত থেকে চায়না রাইফেল কেড়ে নিয়ে আরেক কনস্টেবল সুজনকে দেন এডিসি আখতারুল স্যার। যার হাত থেকে চায়না রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়, তখন সে গুলি করা থেকে বিরত ছিল। পরে জেনেছি তার নাম অজয়। এরপর চানখারপুল মোড়ে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো হাঁটু গেড়ে বসে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে থাকে কনস্টেবল সুজন। এপিবিএনের কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমনও নিজের নামে ইস্যু করা চায়না রাইফেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। তাদের গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। পরে অন্য আন্দোলনকারীরা গুলিবিদ্ধদের ধরাধরি করে নিয়ে যান। একপর্যায়ে এপিবিএনের পাঁচ-সাতজন সদস্য নিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের বিভিন্ন গলিতে চায়না রাইফেল নিয়ে গুলি করতে করতে ঢোকেন এসি ইমরুল স্যার ও ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যার।

জবানবন্দিতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন শুনতে পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে চানখারপুল এলাকার পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে টিএসসি মোড় হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে শাহবাগ থানার পেছন দিক দিয়ে থানায় ঢুকি। এ ছাড়া, স্যারের নির্দেশে নিজ নিজ নামে ইস্যু করা অস্ত্র শাহবাগ থানার অস্ত্রাগারে জমা দেই। তবে, নিজের নামে ইস্যু করা চায়না রাইফেলের ৪০ রাউন্ড গুলি জমা দেয় কনস্টেবল নাসিরুল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি তুমি চানখারপুলে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করার পরও ৪০ রাউন্ড গুলি কীভাবে জমা করলে? উত্তরে সে জানায় এডিসি আখতারুল স্যার আমাকে অতিরিক্ত গুলি সরবরাহ করেছেন। এরপর পোশাক বদলে সিভিল ড্রেস পরে এশার নামাজের পর শাহবাগ থানার পেছন দিয়ে বের হয়ে পায়ে হেঁটে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিলে মিরপুর পুলিশ লাইনে রাত ১১টায় পৌঁছাই।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলেও এসআই আশরাফুল ইসলামের জেরা হয়নি। আগামীকাল মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) তাকে জেরা করবেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

এদিকে আজও মামলার অন্যতম আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে এনেছে পুলিশ। তবে নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে এরই মধ্যে ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। এছাড়া শেখ হাসিনার এ মামলায় ১৩তম দিনের মতো এসআই আশরাফুল ছাড়াও আরও দুজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৩৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
যুক্তরাষ্ট্রে দেখা হলো শাবনূর-মৌসুমীর Dec 19, 2025
img
সোহেল আলমের কথায় ফাহমিদা নবীর নতুন গান Dec 19, 2025
img

আরও হামলার শঙ্কা

দেশের সম্পদ রক্ষা করার আহ্বান আসিফ মাহমুদের Dec 19, 2025
img
এনসিপির শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত Dec 19, 2025
img
কুষ্টিয়ায় প্রথম আলোর পত্রিকা অফিসে ভাঙচুর Dec 19, 2025
img
ওমরাহ-তে গিয়ে ২ বছর পর ছেলেকে দেখলেন ওমর সানী Dec 19, 2025
img
ডিপজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মুখ খুললেন অভিনেতা Dec 19, 2025
img
বিএনপির সঙ্গে ৭ দলের বৈঠক, আসন ছাড় পাচ্ছেন মান্না-পার্থ-সাকি Dec 19, 2025
img
১০ তলা থেকে পড়ে প্রাণ হারাল ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার Dec 19, 2025
img
এখানে সবাই আমাকে নিজের করে নিয়েছে : সুস্মিতা Dec 19, 2025
img
হামলা-ভাঙচুর নয়; হাদি চেয়েছিলেন সাংস্কৃতিক জাগরণ : সারোয়ার তুষার Dec 19, 2025
img
মিনারের গান শুনলেন আতিফ, করলেন প্রশংসা Dec 19, 2025
img
লিফট দুর্ঘটনায় চার বছরের ছেলেকে হারালেন কেজিএফ পরিচালক Dec 19, 2025
img
বাবার পাশে শায়িত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন হাদি Dec 19, 2025
img
গণতন্ত্র ও দেশের শত্রুরাই ওসমান হাদিকে হত্যা করেছে: তারেক রহমান Dec 19, 2025
img
তিন বছরে বদলে গেল আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস Dec 19, 2025
img
২৯ জাহাজে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা Dec 19, 2025
img
হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্য দেশকে অস্থিতিশীল করা: মাহদী আমিন Dec 19, 2025
img
হাদির হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকরের দাবি আলোচিত বই বিক্রেতা টিপু সুলতানের Dec 19, 2025
img
শাহবাগ থেকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক Dec 19, 2025