ঠাকুরগাঁওয়ে এজলাস সংকট, ভোগান্তিতে বিচারপ্রার্থীরা

জমি নির্ধারণ নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতায় ঠাকুরগাঁওয়ে মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালত ভবন নির্মাণের কাজ থমকে আছে। এতে বিচারক, আইনজীবী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশেষ করে বিচার-প্রার্থী সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এজলাস সংকট, নথিপত্রের অব্যবস্থাপনা এবং মৌলিক সুবিধার অভাবে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

জেলা আইনজীবী সমিতি ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর নিজস্ব কোনো ভবন না থাকায় ঠাকুরগাঁও জেলা জজ আদালত এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভবনের নিচতলার কয়েকটি কক্ষে অস্থায়ীভাবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যক্রম চলছে। এসব কক্ষে চিফ জুডিশিয়ালসহ মোট ৯টি আদালতে ৬ জন বিচারক বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিধি অনুযায়ী ৯টি আদালতের জন্য ৯ জন বিচারক থাকার কথা থাকলেও এজলাস সংকটের কারণে শুধু ৬ জন বিচারক দিয়ে চলছে কার্যক্রম।

ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, আমরা ২০১০ সাল থেকে চাচ্ছিলাম এই ভবনটি হোক। এসএ ও সিএ রেকর্ড অনুযায়ী এটি জেলা দায়রা জজের নিজস্ব জায়গা। কিন্তু জেলা প্রশাসক ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিল্ডিং করতে দিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আইনের বিধান হচ্ছে, জেলা ও দায়রা জজ সম্বলিত বার ও বেঞ্চের যে জায়গা থাকবে সেখানেই ভবন হবে। কিন্তু এই ভবন না হওয়ার জন্য অসংখ্য মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। প্রশাসনের অযাচিত বক্তব্য হচ্ছে, এখানে জুডিশিয়াল ভবন হলে তাদের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। বিচারপ্রার্থীদের বসার জায়গা নেই, আইনজীবীরা গাছতলায় বসতে বাধ্য হচ্ছেন, এসব না দেখে জেলা প্রশাসক সৌন্দর্যটাকে দেখছেন।

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির জাহেদুল ইসলাম বলেন, চার একর ১২ শতক জমি জেলা জজ আদালতের। তবে এসএ রেকর্ডে কিছু অংশ জেলা প্রশাসকের নামে চলে যায়। ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে আদালতের পক্ষ থেকে দেওয়ানি মামলা করেন তৎকালীন নাজির। ২০২১ সালে জেলা জজ আদালতের পক্ষে রায় হয়। এরপর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আপিল করলেও চার বছরেও শুনানি হয়নি।

গণপূর্ত বিভাগের জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, একাধিকবার মাপজোক করার পরও সিজেএম আদালতের জায়গা নির্ধারণ করা যায়নি। এ বছর জুন মাসে গণপূর্ত বিভাগ থেকে একটি ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। এই প্রকল্প অনুযায়ী ১০০ কোটি ৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৫৮ টাকা ব্যয়ে ১০ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর আটতলাবিশিষ্ট সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা হবে, যার জন্য জমি প্রয়োজন ১.২০ একর।

ঠাকুরগাঁও গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের ফাঁকা জায়গাটি এস্টিমেট করে পাঠানো হয়েছে। যে জায়গায় এস্টিমেট করা হয়েছে, সেখানে যদি না হয়, তাহলে নতুন জায়গা লাগবে। প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত থাকবে। এই সময়ের মধ্যে জায়গা নির্ধারণ করা না গেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে না এবং টাকা ফেরত চলে যাবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচতলায় আদালতের বারান্দায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে কয়েকশ বিচারপ্রার্থী। বসার জায়গা না থাকায় অনেকে রোদের মধ্যে খোলা মাঠে অবস্থান নেন। নারী বিচার-প্রার্থীরা শিশুদের নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন।

৭৩ বছর বয়সী বিচারপ্রার্থী আলিয়া বেগম বলেন, অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছি, পা ব্যথা করছে। বসার ব্যবস্থা আর ফ্যানের ব্যবস্থা হলে ভালো হতো। আরেক বিচারপ্রার্থী সিদ্দিকুল জানান, তারা সকাল ৯টায় এসে দুপুরের পর হাজিরার ডাক পান।

স্থান সংকটের কারণে একটি কক্ষে একাধিক দাপ্তরিক কাজকর্ম সারছেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বিচারকদের রায়ের নথি প্রস্তুতকারী ‘স্টেনো টাইপিস্টদের’ জন্য আলাদা কোনো রুম নেই, ফলে গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করা সম্ভব হয় না। আদালতের সেরেস্তা রুম না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো অরক্ষিত অবস্থায় এজলাসে রাখা হয়েছে, যা হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।

চিফ জুডিশিয়াল আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন বলেন, চলমান মামলার নথি সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি কোর্টের বিপরীতে সেরেস্তা রুমের প্রয়োজন হলেও একটিও নেই।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের নাজির হামিদুল হক বলেন, ভবন না থাকায় আমরা ২০ জন কর্মচারী একই রুমে গাদাগাদি করে বসতে বাধ্য হচ্ছি। এতে দাপ্তরিক কাজ করা খুবই কষ্টকর।

এ ছাড়া, বিচারপ্রার্থীদের জন্য টয়লেট নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচতলার সিজেএম আদালত ভবনে দুটি টয়লেট থাকলেও সেগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, চিফ জুডিশিয়াল ভবন নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ এই কথাটা ঠিক নয়। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি এবং বিগত জেলা প্রশাসকরা প্রত্যেকে চেয়েছেন সিজেএম কোর্ট হোক। সমস্যা হচ্ছে স্থান নিয়ে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে উচ্চপর্যায়ের লোকজন ও বিভিন্ন সরকারি প্রোগ্রামের জন্য ব্যাপক লোকসমাগম হয়। ১০তলা ভবন হলে এই স্থানে চলাচলে অসুবিধা হবে, সম্ভবত এই কারণে পূর্ববর্তী জেলা প্রশাসকরা আপত্তি করেছেন।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. জালাল উদ্দিন বলেন, ভবন নির্মাণের জন্য সবাইকে একমত হওয়া উচিত। এটি দ্রুত বিচার কার্যক্রমে সহায়ক হবে।

ইউটি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

১৯ বছর পর বাবার কবরের পাশে তারেক রহমান Dec 27, 2025
বিপিএলে সিলেট কে হা/রি/য়ে শুভ সূচনা রাজশাহীর Dec 27, 2025
‘জেলার ২’-এ কি ফিরছে রজনীকান্ত–শাহরুখ জুটি? Dec 27, 2025
ক্ষুধার বি/রু/দ্ধে ১১ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা টেইলর সুইফটের Dec 27, 2025
img
আটলান্টিক মহাসাগরে নৌকাডুবি, ১২ জনের নিথর দেহ উদ্ধার Dec 27, 2025
img
ঘন কুয়াশায় পদ্মার চরে আটকে পড়া লঞ্চের শতাধিক যাত্রী উদ্ধার Dec 27, 2025
img
খুলনায় প্রাইভেটকারের ধাক্কায় প্রাণ গেল নারীর, চালক আটক Dec 27, 2025
img
রজনীকান্তের সঙ্গে বড় পর্দায় প্রথমবার শাহরুখ Dec 27, 2025
img
হারের জন্য 'শিশিরকে' দুষলেন মিরাজ Dec 27, 2025
img
পরচুলা পরে করা যাবে না অভিনয়, দাবি পূরণ না হওয়াতেই ‘দৃশ্যম ৩’ থেকে সরলেন অক্ষয় খান্না! Dec 27, 2025
img
ভারতে বাংলাদেশিদের হোটেল ভাড়া না দেওয়ার হুমকি Dec 27, 2025
img
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নগর সরকার : চসিক মেয়র Dec 27, 2025
img
সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নতুন নির্দেশনা অধিদপ্তরের Dec 27, 2025
img
নিজেদের প্রথম ম্যাচে চট্টগ্রামের বিপক্ষে নোয়াখালীর হার Dec 27, 2025
img
মধ্যরাতে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ, আহত ১০ Dec 27, 2025
img
অনুমতি জটিলতায় তাহেরির ওয়াজ মাহফিল বন্ধ, ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা Dec 27, 2025
img
ইতালিতে বাংলাদেশিদের হাতেই নির্যাতিত বাংলাদেশি Dec 27, 2025
img
জবির ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা আজ, আসনপ্রতি লড়বেন ৪০ জন Dec 27, 2025
img
রাতেই জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা Dec 27, 2025
img
আজ যেসব কর্মসূচিতে যাচ্ছেন তারেক রহমান Dec 27, 2025