দুটি চিকিৎসা যন্ত্রের দামে ১৪ কোটি টাকার পার্থক্য কেন? : স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম

দেশের ক্যান্সার চিকিৎসার মূল সমস্যা টাকার অভাব নয়, বরং সিস্টেমের মধ্যে থাকা গলদ, দুর্নীতি আর অপচয় এমন মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। 

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ক্যান্সার হাসপাতালে একই মানের দুটি চিকিৎসা যন্ত্রের দামে ১৪ কোটি টাকার পার্থক্য কেন? এই বাড়তি টাকায় হাসপাতালে কী ঢুকলো? 

এসময় তিনি সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং জটিল সিস্টেমের গলদ নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করেন।

রোববার (২৭ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ক্যান্সার চিকিৎসায় মেশিন ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, একটি মেশিনের দাম ২৪ কোটি, অন্যটির ৩৮ কোটি টাকা- মান প্রায় একই, কিন্তু দামের পার্থক্য ১৪ কোটি কেন? কারণ সিস্টেমে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যা বাস্তবে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।

তিনি বলেন, আমাদের ভাবতে হবে, এই সিস্টেম থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। কারণ এই সিস্টেমটাই রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত করছে, জনগণের টাকা নষ্ট করছে।

তার মতে, সরকারি খাতে যন্ত্রপাতি কেনা বা প্রকল্প বাস্তবায়নের নিয়মগুলো এমনভাবে তৈরি যে, আসল প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা ব্যয় হয়- অথচ সেবার মান তাতে বাড়ে না।

অপচয় বন্ধ করে রোগীর জন্য খরচ করুন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, টাকা কম না, অপচয় বেশি। 

তিনি হাসপাতালের অপ্রয়োজনীয় খরচের উদাহরণ টেনে বলেন, একটা ফুলের তোড়ায় ১৫০০–১৬০০ টাকা খরচ হয়, অথচ এই টাকায় অন্তত একজন রোগীর ওষুধ কেনা যেত।

তিনি বলেন, যেই অপচয়টা আমরা করছি, সেটা যদি আমি আমার রোগীর পেছনে খরচ করতে পারি- তাতেই হবে আসল উন্নয়ন। 

প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলা

নূরজাহান বেগম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমরা প্রিভেনশন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বাজেট কমে যাচ্ছে।

তিনি মনে করেন, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই শুরু করতে হলে আগে থেকেই মানুষকে সচেতন করতে হবে। ক্যান্সার একদিনে হয় না- বছরের পর বছর তামাকের সংস্পর্শে, অস্বাস্থ্যকর খাবারে, জীবনযাপনে তৈরি হয়। স্কুলের মেয়েদের যদি এই শিক্ষা দেওয়া যেতো, তাহলে তারা ঘরে গিয়ে মাকে, দাদিকে বলতো। এতে রোগ আগেভাগে ধরা পড়ত।
রোগীর কষ্ট, হাসপাতালের বিশৃঙ্খলা

নূরজাহান বেগম বলেন, একজন রোগী চিকিৎসার জন্য ২৬ হাজার টাকা খরচ করে, যার বেশিরভাগই ধার করা টাকা। তিনি হাসপাতালের বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ে বলেন, অনেক রোগী ভর্তি হতে না পেরে তিন দিন বারান্দায় ঘুমায়। কেউ রাস্তায় রাত কাটায়। অন্তত তাদের জন্য একটু জায়গা, একটু শৃঙ্খলার ব্যবস্থা থাকা উচিত।

তিনি বলেন, রোগীর সঙ্গে অতিরিক্ত এটেনডেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিনিধিদের অবাধ প্রবেশ হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করছে। হাসপাতালের ইনডোরে ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারবে না- এমন ব্যবস্থা করা দরকার।

প্রাইভেট সেক্টর পারে, সরকার কেন পারে না?

সরকারি ক্রয়নীতির জটিলতা নিয়ে তিনি বলেন, প্রাইভেট সেক্টর ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারে সরাসরি যন্ত্রপাতি কিনে আনতে পারে, সরকার কেন পারে না? নতুন নতুন নীতিমালা (পিপিআর) যুক্ত হচ্ছে, কিন্তু জটিলতা কমছে না।”

তার মতে, এই সিস্টেমে যত নতুন ধারা যোগ হয়, জনগণ ততই ‘পৃষ্ঠ’ হয়।

নূরজাহান বেগম জানান, ক্যান্সার চিকিৎসায় আসল বাধা অর্থ নয়, বরং দুর্নীতি আর জটিল সিস্টেম। ১৪ কোটি টাকায় কী ঢুকলো প্রশ্নটি কেবল একটি যন্ত্রের নয়, পুরো ব্যবস্থার প্রতীক। 
তার কথায়, অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ যদি রোগীর জন্য খরচ করা যায়- সেটাই হবে আসল উন্নয়ন।

সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।

আরপি/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ Dec 12, 2025
img
তরুণ নেতৃত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ 'ওসমান হাদি' Dec 12, 2025
img
ঢাকা-৮ আসনের এমপি পদপ্রার্থী ওসমান হাদী গুলিবিদ্ধ Dec 12, 2025
img
হিরো আলমকে প্রার্থী হিসেবে চায় চার দল Dec 12, 2025
img
নতুন চরিত্রে অভিনয় মানেই নিজেকে নতুনভাবে দেখা: শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় Dec 12, 2025
img
ইংরেজি প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ায় কলেজ ভর্তি পরীক্ষা পরিচালকের পদত্যাগ Dec 12, 2025
img
২২ গজ মাতাতে একসঙ্গে আসছেন গেইল-ক্যালিস-ওয়াটসনসহ কিংবদন্তি তারকারা Dec 12, 2025
img
দর্শকের অনুরোধে গান গাইতে হয় নায়িকাদের: মানালি দে Dec 12, 2025
img
প্রথম নাটকে কত টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তৌকির আহমেদ? Dec 12, 2025
img
নির্বাচনে ৩টির বেশি আসনে প্রার্থী হওয়া যাবে না: ইসি Dec 12, 2025
img
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ১৪৩তম জন্মবার্ষিকী আজ Dec 12, 2025
img
আমার প্রথম রোজগার ৬৪ টাকা: ঈশিতা Dec 12, 2025
img
সাগরপাড়ে মুগ্ধতা ছড়ালেন ‘ভ্রমণকন্যা’ মিম Dec 12, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বকাপে ২ দলকে নিয়ে বিপাকে ফিফা Dec 12, 2025
img
মেসিকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত থাকবেন শাহরুখ খান, এক মঞ্চে দেখা যাবে দুই মহাতারকাকে Dec 12, 2025
img
মুর্শিদাবাদের বাবরি মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আজ, হাজারো মুসল্লির ভিড় Dec 12, 2025
img
নির্বাচনি ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছাতে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে: আবু সুফিয়ান Dec 12, 2025
img
গাজীপুরে খোলা ড্রেনের ভেতর পড়ে গেল গরু, জীবিত উদ্ধার Dec 12, 2025
img
৩০ ডিআইজিসহ ৩৯ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি Dec 12, 2025
img
কন্যাসন্তানের বাবা হলেন অভিনেতা অপূর্ব Dec 12, 2025