২১ নভেম্বর, সকালটা খুবই সুন্দর ছিল। ঘুম ভাঙলো আব্বু-আম্মুর ডাকে। আমাদের হোটেল 'Grande Centre Point ploenchit' এ আগের হোটেলের মতই 'ব্রেড এন্ড ব্রেকফাস্ট' এর ব্যবস্থা ছিল। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম নাস্তা করতে। এখানেও ছিল বুফে সিস্টেম। থরে থরে খাবার সাজানো ছিল। আমি তো বাচ্চাদের মত গণনা করা শুরু করে দিয়েছিলাম। ১৩০ টি আইটেম গণনা করার পর আর গুণতেই পারিনি। আগের হোটেলের আইটেম সংখ্যা এরকমই ছিল।
যাহোক, পেট ভরে নাস্তা করার পর স্যুটে ফিরে এলাম। আমাদের থাইল্যান্ড ট্যুরের শেষের দিকের দিনগুলো বেশ অলসতায় কাটছিল। নাশতা শেষে আম্মু চলে গেলেন কনফারেন্সে এবং বাবা চলে গেলেন তার কাজে আর আমি স্যুটে ফিরে এসেই দিলাম আরেক দফা ঘুম। ঘুম ভাঙলো দুপুরের দিকে। বাবার সাথে গেলাম একটা বাঙালি রেস্টুরেন্টে। আমি আর বাবা খেলাম 'মাটন বিরিয়ানি '। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম বিদেশের মাটিতে সকল বাঙালি রেস্টুরেন্টের মানুষগুলো অনেক বেশি আন্তরিক হয়। খাওয়া শেষ করে স্যুটে ফিরে এলাম। আম্মুও ইতোমধ্যে ফিরে এলেন।
এরপর শুরু হলো আমাদের 'মাদাম তুসো' যাত্রা। আমি ট্যাক্সিতে উঠেও বারবার বলছিলাম আমার 'মাদাম তুসো' তে যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। কারণ আমি ছোটবেলায় লন্ডনের 'মাদাম তুসো' তে গিয়েছি। সুতরাং আমার যেতে ইচ্ছে করছিলোনা। তবুও আব্বু-আম্মু বুঝালেন ভালো না লাগলে অল্প সময় থেকে চলে আসবো।
আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন খুবই আন্তরিক। তিনি 'মাদাম তুসো' তে পৌঁছাবার পর টিকেট থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কিছু করে দিয়েছিলেন। তার আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। টিকেট হাতে পেয়েই 'মাদাম তুসো'তে প্রবেশ করলাম। সেখানে প্রবেশ করতেই তারা একটা গাড়ির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে ছবি তুললেন। এরপর আমাদের দর্শন পর্ব শুরু হলো।
আগে ধারনা দিয়ে রাখি 'মাদাম তুসো জাদুঘরে' কী থাকে। এখানে মোম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত, জনপ্রিয় এবং ঐতিহাসিক মানুষদের মূর্তি সংরক্ষিত থাকে। যাহোক, বিভিন্ন দেশের নেতা, নেত্রী, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজা, রানীদের মধ্যে সেখানে ছিল রানী এলিজাবেথ, বারাক ওবামা, মিশেল ওবামা, শি জিনপিং, অং সান সুচি, মাহাথির বিন মোহাম্মদ, দালাই লামা, নরেন্দ্র মোদি, ভ্লাদিমির পুতিনসহ আরও অনেকের মূর্তি।
বিভিন্ন দেশের অভিনেতা, অভিনেত্রীদের মূর্তিও দেখলাম। যেমন- শাহরুখ খান,ক্যাটরিনা কাইফ, রনবীর কাপুর, প্রভাস, জ্যাকি চান, Mario Maurer,স্পাইডার ম্যান, টনি জা, হিউ জ্যাকমান, LT.Col.Wanchana Sawasdee,ব্রুস লি, এঞ্জেলিনা জোলি, ব্রাড পিট, মিশেল ইয়ো, ভিন ডাইসেল, ক্রিস ইভান্সসহ আরও অনেক খ্যাতনামা অভিনেতা অভিনেত্রীর নিখুঁত কারুকার্যের মূর্তি।
এছাড়াও ছিল আইনস্টাইন, মার্ক জাকারবার্গ, লুডউইগ ভ্যান বিটোফেন, পাবলো পিকাসো সহ যারা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চায় অবদান রেখেছেন তাদের মূর্তি।
আসলে সবার নাম মনে রাখা খুব দুরূহ। খেলোয়াড়দের মূর্তিরও যেনো মেলা বসেছিলো সেখানে। ডেভিড বেকহ্যাম, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সেরেনা উইলিয়ামস, স্টিভেন জেরার্ড, ওয়েইন রুনি, ইয়াও মিংসহ অনেক খেলোয়াড়দের মূর্তি ছিল সেখানে।
এছাড়াও বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীর মূর্তির দেখা পেলাম। এদের মধ্যে লেডি গাগা, বিয়ন্সে, কেটি পেরি, মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা অন্যতম। দর্শন পেলাম আরও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মূর্তি যাদের নাম আমি জানি না কিংবা জানলেও মনে পড়ছে না।
মাদাম তুসো জাদুঘরের উপর তলায় ছিল '4D Movie' দেখার ব্যবস্থা। আমরা সেখানে যাওয়ার পর জানলাম ১৫ মিনিট পর শো শুরু হবে। অপেক্ষা করতে লাগলাম শোয়ের জন্য। এরমধ্যে 'কোন আইসক্রিম' খেলাম। দেখতে দেখতে ১৫ মিনিট পার হয়ে গেল। সিনেমা হলের মতো কক্ষে 4D 'সানগ্লাস' সহ প্রবেশ করলাম। মুভি শুরু হলো। প্রচণ্ড রিয়েলিস্টিক ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয়টি ছিল মুভিতে জল ছিটানোর দৃশ্যে আমাদের মুখেও জল ছিটিয়ে দিচ্ছিলো। এছাড়াও তুষারপাতের সময় ঠাণ্ডা অনুভূতির সাথে সাথে আমাদের গায়েও নকল তুষারপাত হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমরা যেনো মুভির ভিতরে ঢুকে পড়েছি।
মুভিটি ছিল খুব সম্ভবত ১৫ মিনিটের। মুভি দেখা শেষ করে রাস্তার অপরপাশে অবস্থিত 'এমবিকে শপিং সেন্টারে' গেলাম। টুকিটাকি কেনা কাটা করে সেই শপিং সেন্টারের একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে ফিরে এলাম আমাদের হোটেলে।
২২ তারিখ সকালে উঠে আগেরদিনের মতোই ব্রেক ফাস্ট করলাম। ১২ টার দিকে চেক আউট ছিল হোটেলের। ১২ টার মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে লবিতে স্যুটকেস রেখে লাঞ্চ করতে চলে গেলাম আমি আর বাবা। এক ইন্ডিয়ান হালাল রেস্টুরেন্টে স্পেগেটি উইথ বীফ খেয়েছিলাম। এরপর আবার লবিতে এসে ওয়েট করতে লাগলাম।
লবিতে ছিল নানারকমের কফি যা কিনা একদম ফ্রি। এত রকমের কফি! প্রায় বিকাল পর্যন্ত আমরা হোটেলের লবিতে ছিলাম। এরপর রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের ফ্লাইট ছিল ১১টা ১৫ মিনিটে। এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছি। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে অনেকক্ষণ ধরে বোর্ডিং এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ও হ্যাঁ এর মাঝে এয়ারপোর্টের একটা রেস্টুরেন্টে 'স্পেগেটি উইথ সী ফুড' দিয়ে রাতের খাবার খেলাম।
যাইহোক ১১টায় প্লেনে উঠলাম এবং ১১টা ১৫ মিনিটে প্লেন ছাড়ল। প্লেন ছাড়ার পরের অভিজ্ঞতা আগের মতনই। খাবারের মেনুও একই যদিও এবারের আইটেমে ফিশ নিয়েছিলাম। প্রায় ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর আমাদের বিমান ঢাকায় পৌঁছাল।
আমরা ঢাকা থেকে সকাল সাড়ে ৫ টার দিকে ময়মনসিংহ আসি। চেনা ঘর, চেনা শহর দেখে ভাল লাগছিল।
এই ছিল আমার থাইল্যান্ড ভ্রমণ। থাইল্যান্ডের মানুষদের ব্যবহার আমাকে অনেক বেশি মোহিত করেছে। তারা আমাদের চিনতো না কিন্তু রাস্তাঘাটে তারা আমাদের 'সোয়াদিখা' বলতেন। কিংবা ইন্ডিয়ান ভেবে 'নমস্তে' বলতেন। কেউ কেউ তো আসসালামু আলাইকুমও বলতেন।
আরেকটা কথা, থাইল্যান্ডের মানুষরা অনেক সৎ, তাদের সততা আমাদের মুগ্ধ করেছে। সত্যিই এই থাইল্যান্ড ভ্রমণ আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
টাইমস/টিএইচ