রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে নিজেদের ফ্ল্যাটে মা ও মেয়ে হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন ‘গৃহকর্মী আয়েশাকে’ শনাক্ত করা হয়েছে। তার প্রকৃত নাম-পরিচয় ও তার স্বামীর নামও জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত ওই গৃহকর্মীকে গ্রেফতার করা যায়নি।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, ওই তরুণীকে শনাক্ত ও নাম-পরিচয় বের করা হলেও তাকে গ্রেফতারের পর তা প্রকাশ করা হবে। গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে হত্যার কারণ।
এর আগে মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে গণমাধ্যমকে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ভবনের নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, লায়লা আফরোজের পরিবার তাকে বলেছিলেন তাদের একজন গৃহকর্মীর প্রয়োজন।
চার দিন আগে এক নারী বাসার সামনে এসে কাজের সন্ধান করলে তাকে লায়লার কাছে নিয়ে যান তিনি। ওই নারীর সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল না।
নিহতদের স্বজনরাও জানান, ঘটনার চার দিন আগে ভবনের নিরাপত্তাকর্মীর মাধ্যমে ওই গৃহকর্মীকে কাজে নেন লায়লা। গৃহকর্মী সকালে আসতেন এবং কাজ শেষে চলে যেতেন। তার পরিচয় ও মুঠোফোন নম্বর জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা কথা বলে তিনি তার পুরো পরিচয় ও মুঠোফোন নম্বর দেননি।
গত সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে শাহজাহান রোডের ১৪ তলা একটি আবাসিক ভবনের সপ্তম তলায় লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিয়াকে (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
এদিকে ভবনের ভেতরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর এক নারী স্কুলড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। চার দিন আগে আয়েশা পরিচয় দিয়ে ওই বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেওয়া তরুণী (২০) এই জোড়া খুনে জড়িত বলে সন্দেহ স্বজনদের। ঘটনার পর থেকে ওই তরুণী পলাতক।
‘আয়েশা’কে গ্রেফতার এবং এই জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্তে নেমেছে পুলিশ, র্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গৃহকর্মী তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানা দেননি। তাকে কেউ চিনতেও পারছিলেন না। ঘটনার সময় তার সঙ্গে কোনো মোবাইল ফোনও ছিল না। বাসা থেকে তিনি যে ফোন নিয়ে গেছেন, সেটাও বের হয়েই বন্ধ করে দেন। আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সচল না থাকায় ওই বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে কোনদিকে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
সূত্র বলেছে, ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে ওই তরুণীর চার দিনের মোবাইল ফোনে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সব সময় বোরকা পরে থাকায় ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায়ও তার মুখ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। ফলে তাকে শনাক্তে ম্যানুয়ালি কাজ করতে হয়। সম্ভাব্য সব ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে শনাক্ত করা হয়।
এর আগে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান সাংবাদিকদের বলেন, গৃহকর্মীর নাম-ঠিকানা ও কোনো মোবাইল ফোন না থাকায় পরিচয় জানা যাচ্ছিল না।
জোড়া হত্যার ঘটনায় সোমবার রাতে ‘গৃহকর্মী আয়েশা’কে একমাত্র আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত লায়লা আফরোজের স্বামী স্কুলশিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সোমবার সকাল ৭টার দিকে তিনি উত্তরায় স্কুলে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় স্ত্রীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি বাসায় ফিরে স্ত্রী ও মেয়ের রক্তে ভেজা লাশ দেখেন। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, আয়েশা সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে কাজ করার জন্য বাসায় আসেন এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান।
বাদী এজাহারে আরও বলেন, অজ্ঞাত কারণে গৃহকর্মী আয়েশা তার স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি অথবা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেছেন।
সুরতহাল প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লায়লা আফরোজের শরীরে প্রায় ৩০টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার মেয়ে নাফিসার শরীরে ৪টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। পুলিশ অভিযুক্তকে শনাক্তের চেষ্টা করছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে লায়লা ও তার মেয়ের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর পৌরসভার দক্ষিণ বড়গাছায় নেওয়া হয়। জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের মরদেহ দাফন করা হয়।
মামলার এজাহারে বাসা থেকে মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। মঙ্গলবার তাদের মরদেহ নাটোরে দাফন করা হয়।
আরপি/এসএন