কোভিড-১৯ : সময় গেলে সাধন হবে না

কয়দিন আগেও আমরা কেউ ভাবতে পারি নাই যে, এমন একটা মহাসঙ্কট আমাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করবে। উহানের লোকেরাও ভাবতে পারে নাই, ইতালির মানুষজনও কিন্তু ভাবে নাই। কে কি ভাবল, কে কি ভাবল না তাতে সত্যিই এখন আর তেমন কিছু আসে যায় না। কারণ, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে আছি আমরা। কি করে নিজেদেরকে বাঁচানো যায়, সেটাই এখন একমাত্র ভাববার মতো বিষয়। হয়তো এখনো খুব বেশি দেরী হয়ে যায় নাই।

কোভিড-১৯ এর মতো একটা ছোঁয়াচে রোগের হাত থেকে বাঁচতে সব থেকে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো- সচেতনতা আর বিচ্ছিন্নতা। সেই ডিসেম্বরে করোনা যখন উহানে তার থাবা বসাতে শুরু করল, তখন থেকেই বারবার মিডিয়াগুলি মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে আসছে।

ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাণী- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করুন, সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ করবেন না, বিদেশ থেকে ফিরলে বা সর্দি-কাশি দেখা দিলে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতা (সেলফ কোয়ারেন্টাইন) মেনে চলুন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই মার্চে এসে যখন আমাদের সমাজে করোনা হানা দিতে শুরু করেছে, আমরা তখন কতটা সচেতন?

প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ফিরেই বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে পার্টি করে বেড়িয়েছেন, তারপর করোনা ঠেকাতে অর্ধ-লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়ে দোয়া করেছে, আগে যারা নামাজে যেতেন না শুক্রবারে তারাও মসজিদে গিয়ে হাজির হয়েছেন। এমন একটা মহামারীর সামনে দাড়িয়ে তিনটি সংসদীয় আসনে উপ-নির্বাচনও হয়ে গেল।

আরও মজার ঘটনা হলো- মহামারীর সম্মুখে দাড়িয়ে রোববার (২৫ মার্চ) বিকাল পাঁচটায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের লোকজন দল বেঁধে রাস্তায় নেমে করোনা দূর করতে থালা-বাটি বাজিয়েছেন, মিছিল করেছেন। এখানেও অনেকে সচেতনতার বদলে ধর্মের দোহায় দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালনা করে চলেছেন। মূর্খতার একটা সীমা থাকা দরকার, আমরা তার চরম সীমাও হাসতে খেলতে লঙ্ঘন করছি। আমরা ছোঁয়াচে একটা রোগকে নিজে থেকে ডেকে ঘরে আনতে উদ্যত হয়েছি।

তবে, আশার কথা হলো- স্কুল-কলেজগুলি বন্ধ করা হয়েছে, গণ-জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, দশ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয়েছে, সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থানীয়ভাবে করোনা পরীক্ষার কিট উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। বিভাগীয় মেডিকেল কলেজগুলিতে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের মতো ঘন বসতিপূর্ণ দেশগুলিতে কোনো পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ সচেতন হবে।

আতঙ্কিত হবেন না, সচেতন হোন। তবে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সামনে কি অপেক্ষা করছে, সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। মিরপুরে করোনায় নিহত ব্যক্তির আত্মীয়দের কেউ বিদেশ ফেরত নন, তবুও তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, অর্থাৎ ভাইরাসটি কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। উনাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তার নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। ডাক্তারদের কাছে এখনো পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, যখন দেশে মাত্র ২৪ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল, তখন ১০ জন চিকিৎসককে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছিল (দ্য ডেইলি স্টার)। এই হারে ডাক্তাররা কোয়ারেন্টাইনে চলে গেলে আপনার-আমার চিকিৎসা কে করবে?

একমাত্র ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও এখনো করোনার পরীক্ষা শুরু হয়নি, রয়েছে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের স্বল্পতা। হাসপাতালগুলি সর্দি-কাশির রোগীদের চিকিৎসা করতে চাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলার পরেও আইইডিসিআর নমুনা সংগ্রহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে (দ্য ডেইলি স্টার)। বেশ কয়েকজন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না তাদের করোনা হয়েছিল কিনা কিংবা আরও কতজন সংক্রমিত।

গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে অর্থনীতির মারপ্যাঁচ। একবার ভাবুন তো, সব মানুষ ঘরে বসে থাকলে অর্থনীতির চাকা কি করে ঘুরবে? আবার, যারা সরকারি চাকুরে বা যাদের সঞ্চয় আছে তারা না হয় জরুরি অবস্থায় একমাস কিংবা দু’মাস ঘরে বসে কাটিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, যারা দিন এনে দিন খান, তারা ঘরে বসে থাকলে তাদের পেটের ভাত জুটবে কোথা থেকে? সরকার অবশ্য স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে আশ্বাস দিয়েছে। তবে মহামারী ঠেকাতে না পারলে সবকিছু করেও শেষ রক্ষা হবে কি?

হয়তো খুব শিগগিরই সরকারের আরও কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপের ঘোষণা আসবে। কিন্তু শুধু সরকার বা রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, এই মহাসঙ্কট মোকাবেলায় আমাদের নিজেদেরকে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে, পাশের লোকটিকে সচেতন করতে হবে।

আমাদের হাতে এই মুহূর্তে করোনার বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর অস্ত্র ‘সচেতনতা’, শুধু সচেতনতার দ্বারা মহামারীটিকে প্রাথমিক পর্যায়ে আটকে দেয়া সম্ভব হলেও হতে পারে। সচেতনতার অভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ইতালি কোভিড-১৯ মহামারীতে হাবুডুবু খাচ্ছে, লাশের সারি বেড়েই চলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিও হিমশিম খাচ্ছে।

আমাদের সমাজে মহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কতটা কি করতে পারবো সেটা ভেবে দেখার সময় চলে যাচ্ছে। সময় পেরিয়ে যাবার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তাদের দায়টা বেশি, তবে আমাকে আপনাকেও নিজ দায়িত্বে কোভিড-১৯ বিস্তারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজে সচেতন হোন, পাশের মানুষটিকে সচেতন করুন। সমাজে অন্যদের মাঝে রোগটি ছড়িয়ে পড়লে আপনিও নিরাপদে থাকতে পারবেন না, রোগটি ছড়াতেই থাকবে। তাই নিজে বাঁচুন, নিজে বাঁচতে অপরকে বাঁচান।

এই মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর সরকারের দিক-নির্দেশনা মেনে চলাই সব থেকে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন, রোগটি ছোঁয়াচে। ভাইরাসটি মূলত নাক, চোখ, মুখ দিয়ে প্রবেশ করে। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, এই ছড়িয়ে যাওয়া যতটা কমানো যাবে, মহামারী ততটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ভাইরাসটি কোন কারণে আপনার হাতে লেগে গেলে তা হাত থেকে নাক-চোখ-মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই বারবার সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে। সর্দি-কাশি দেখা দিলেই কোভিড-১৯ হয়েছে কি হয়নি পরীক্ষা না করে সেটা বলা কঠিন। তাই স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করুন, অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন, মাস্ক ব্যবহার করুন।

ভাইরাসটি দীর্ঘদিন শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয় সেটা বোঝা খুব কঠিন। সুতরাং সবার থেকেই তিন ফুটের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন, তাতেই মঙ্গল।

সবাই মিলে ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করতে হবে, সবার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই সেটা সম্ভব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জটলা পাকিয়ে দোয়া করতে বসে যাওয়ার আগে, দল বেঁধে থালা-বাটি বাজিয়ে কীর্তন করার আগে, ভাবুন তো যদি পাশের লোকটি কোভিড-১৯ রোগটির সুপ্ত বাহক হয়ে থাকেন, তখন আপনার কী হবে? নিজের কথা না ভাবলেও পরিবারের ছোট সদস্যটির কথা ভাবুন, বয়স্ক ব্যক্তিটির কথা ভাবুন, নিজের প্রিয়জনের কথা ভাবুন। আপনি আক্রান্ত হলে আপনার আশেপাশের লোকেরা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে যাবেন।

এখন সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার, এখন সময় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের। পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে হবে, সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। যারা সবকিছুর পরেও দল বেঁধে মূর্খতা করে বেড়াচ্ছেন, তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করুন, তাদের থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন।

ধেয়ে আসতে থাকা একটা ভয়ঙ্কর মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান, আমরাও করোনা মোকাবেলার একটা অসম যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশ ইতালি নয়, চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রও নয়। আমাদের জনসংখ্যা বিপুল, সে তুলনায় সম্পদ খুব সীমিত। চীন দশ দিনে হাসপাতাল গড়ে তুলতে পেরেছে, আমরা হয়তো সেটা পারবো না।

একদিনে হঠাৎ করেই সবকিছুর হিসেব-নিকেশও বদলে যাবে না, তারপরেও আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। সব সীমাবদ্ধতা নিয়েই এই মহামারীর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তাই এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সাহস হারালে চলবে না, সচেতনতার সঙ্গে মোকাবেলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আর সেটা করতে হবে সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই।

লেখক: তরুণ সাংবাদিক

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্ববাজারে ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম Sep 16, 2025
img
দুই জয়ে ‘বি’ গ্রুপের শীর্ষে শ্রীলঙ্কা, খালি হাতে বিদায় নিল হংকং Sep 16, 2025
img
ভোজ্যতেল আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি করল এনবিআর Sep 16, 2025
img
ইভ্যালি থেকে বেরিয়ে একই কৌশলে প্রতারণা, নারী গ্রেপ্তার Sep 16, 2025
img
এশিয়া কাপ জিতেনি বাংলাদেশ গুগোল করে নিশ্চিত হলেন ট্রট Sep 16, 2025
img
ড. ইউনূস ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের স্বপ্ন বিনষ্ট হবে : রাশেদ খান Sep 16, 2025
img
ডাকসুর ভোট ম্যানুয়ালি গণনার জন্য উমামার লিখিত আবেদন Sep 16, 2025
img

মাসুদ সাঈদী

জনগণের ভালোবাসা অর্জন করুন, তাহলে নির্বাচন বর্জনের দরকার হবে না Sep 16, 2025
img
আরও ১ মাস বাড়লো ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ Sep 16, 2025
img
আগস্টে ৪৯ মামলায় জড়িত ৩১১ দুর্নীতিবাজ Sep 15, 2025
img
১৫ কেজির কোরাল মাছ বিক্রি ১৮ হাজারে Sep 15, 2025
img
শ্রীলঙ্কার সামনে হংকংয়ের ১৫০ রানের চ্যালেঞ্জ Sep 15, 2025
img
নিকুঞ্জে নাগরিক জাগরণ: হারানো শান্তি ফিরে পাওয়ার গল্প Sep 15, 2025
img
সুপার ফোরে খেলবে বাংলাদেশ, আত্মবিশ্বাসী কোচ Sep 15, 2025
img
ম্যাচের আগে বাংলাদেশের প্রশংসায় জনাথন ট্রট Sep 15, 2025
img
অসুস্থ অমিতাভকে ২০০ জন ৬০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলেন Sep 15, 2025
img
অতিরিক্ত ৬ বছরের কারাভোগ শেষে ভারতে ফিরলেন রামাতা Sep 15, 2025
এশিয়া কাপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, সুপার ফোর নিশ্চিত কার? Sep 15, 2025
img
আলোচনা ভেস্তে দিতেই দোহায় হামলা : কাতারি আমির Sep 15, 2025
img
তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহী চীন, পাঠাচ্ছে কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল Sep 15, 2025