কোভিড-১৯: যেভাবে বদলে যাবে সমাজের চরিত্র

কোভিড-১৯ রোগটির প্রাদুর্ভাবের পর বদলে যাবে আমাদের চিরচেনা পৃথিবী, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবর্তন আসবে আমাদের জীবনধারা থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে। এমনকি বদলে যাবে বিশ্বের সমাজ বা সম্প্রদায়গুলির চরিত্রও। পরিবর্তন আসতে পারে ব্যক্তিগত চেতনা, ধর্মীয় উৎসব, সরকার, রাজনীতি ও দেশপ্রেমের ধারণায়।

আসুন জেনে নিই, নোভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে আমাদের চিরচেনা পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে-

ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে
লেখক: দেবোরা টানেন, জর্জটাউনের ভাষাবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক

৯/১১-তে আমেরিকানরা আবিষ্কার করেছিলেন- যে দুর্যোগের ঝুঁকিতে আমরা রয়েছি, এতদিন ভাবা হতো সেটি কেবল দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতেই ঘটে থাকে। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক সঙ্কট আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, আমরা অর্থনৈতিক মন্দার মতো অতীতের বিপর্যয়গুলোতে আবার পড়তে পারি। এখনও, ১৯১৮ সালের ফ্লু মহামারীটি আমাদের জীবনে আকস্মিক জল্পনা।

আমরা এখন জানি যে- কোনো জিনিস স্পর্শ করা, অন্য লোকের সংস্পর্শে থাকা এবং একটি বদ্ধ স্থানে নিঃশ্বাস ফেলা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই সচেতনতা কতটা দ্রুত মানুষ ভুলে যাবে, তা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হবে। তবে এই সময়ের মধ্যে যারা বাস করছেন, তাদের পক্ষে কখনই এটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। হাত মেলানো বা মুখ স্পর্শ করার অভ্যাস বদলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং আমরা বারবার হাত ধোয়া বন্ধ করতে পারব না।

এতদিন অন্যের উপস্থিতিতে আমরা যে প্রশান্তি অনুভব করতাম, এখন একা থাকলে সে প্রশান্তি অনুভূত হবে, বিশেষ করে অপরিচিত কারো উপস্থিতিতে আমরা সহজে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো না। এতদিন আমরা প্রশ্ন করতাম- ‌‘এটা অনলাইনে করার বিশেষ কোনো কারণ আছে?’ এখন থেকে আমরা জিজ্ঞাসা করব- ‘ব্যক্তিগতভাবে এটি করার কোনো বিশেষ কারণ আছে?’। অর্থাৎ আমরা এখন যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত উপস্থিতি এড়িয়ে অনলাইনে কাজ সম্পাদনের দিকে ঝুঁকে যাব।

দুর্ভাগ্যক্রমে, যারা বিভিন্ন কারণে ব্রডব্যান্ড সহজে ব্যবহার করতে পারেন না, তারা আরও সুবিধাবঞ্চিত হবে। অনলাইন যোগাযোগের অভ্যাস বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে মানুষে মানুষে শারীরিকভাবে দূরত্ব আরও বেশি বাড়বে। তবে এর ফলে যোগাযোগ বেড়ে যাবে, কারণ যারা দূরে থাকে তাদের সঙ্গে সাধারণত আমরা বেশি যোগাযোগ করি এবং এই দূরত্বের কারণে আমরা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করব।

দেশপ্রেমের নতুন ধারণা তৈরি হবে
লেখক: মার্ক লরেন্স শ্র্যাড, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং আসন্ন স্ম্যাশিং দ্য লিকার মেশিন: অ্যা গ্লোবাল হিস্ট্রি অব প্রহিবিশন গ্রন্থের রচয়িতা

আমেরিকা দীর্ঘদিন সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে দেশপ্রেমের সমীকরণ করেছে। তবে, আপনি চাইলেও কোনো ভাইরাসকে গুলি করতে পারবেন না। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখভাগে থাকা ব্যক্তিরা নকল, ভাড়াটে বা তালিকাভুক্ত পুরুষ নয়; তারা হলেন আমাদের চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, শিক্ষক, সেবাকর্মী, দোকানদার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ছোট-ব্যবসায়ী ও কর্মচারী। লি ওয়েনল্যাং ও উহানের চিকিৎসকদের মতো, অনেকেই হঠাৎ করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দূষণ ও মৃত্যুঝুঁকির কারণে তারা কখনো পিছিয়ে আসেননি।

সব কিছু শেষে, আমরা তাদের আত্মত্যাগকে সত্য দেশপ্রেম হিসেবে স্বীকৃতি জানাব। আমাদের চিকিৎসক এবং নার্সদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলবো- ‘আপনার সেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ যা আমরা এতদিন সামরিক বাহিনীর জন্য করেছি। আমরা তাদের গ্যারান্টিযুক্ত স্বাস্থ্য বেনিফিট ও কর্পোরেট ছাড় দেব এবং মূর্তি তৈরি করব।

এই নতুন শ্রেণীর লোকদের জন্য বিশেষ ছুটি থাকবে, যারা আমাদের জন্য তাদের স্বাস্থ্য ও জীবন উৎসর্গ করে। সম্ভবত, আমরা শেষ পর্যন্ত দেশপ্রেম বলতে অন্য কারও সম্প্রদায়কে উড়িয়ে দেয়া নয়, বরং নিজের সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করাকে বুঝতে শুরু করব। এই মহাসঙ্কটের পরে, আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীর মানুষ দেশপ্রেমকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা থেকে বেড়িয়ে আসবে।

মেরুকরণ হ্রাস হবে
লেখক: পিটার টি কোলম্যান, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক

করোনাভাইরাস মহামারী প্রচলিত ব্যবস্থায় যে ধাক্কা দিচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের গত ৫০ বছরের পরিচিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণ ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা আরও বৃহত্তর ও কার্যকর জাতীয় সংহতির দিকে যাত্রা করতে সহায়তা করবে। এটি আদর্শবাদী চিন্তা মনে হতে পারে; তবে এটি ঘটতে পারে বলে ভাবার দু’টি কারণ রয়েছে।

প্রথমটি হলো- ‘সাধারণ শত্রু’ পরিস্থিতি, যেখানে এতদিন বহিরাগত হুমকি বিবেচনা করা হয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদেরকে এমন এক শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বা করছে, যা লাল ও নীলের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না।

দ্বিতীয় কারণ হলো- ‘রাজনৈতিক শক ওয়েভ’ পরিস্থিতি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শক্তিশালী স্থায়ী সম্পর্কযুক্ত ধাঁচগুলি প্রায়শই কোনো বড় ধরণের ধাক্কার ফলে পরিবর্তনের জন্য আরও বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।

সামাজিক ধাক্কা বিভিন্ন উপায়ে প্রচলিত ধারা ভাঙ্গতে পারে, জিনিসগুলি আরও ভালো বা খারাপ করে তুলতে পারে। তবে আমাদের বর্তমান স্তরের উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃশ্য বোঝা যায় যে, এখন আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ডিসকোর্সে আরও গঠনমূলক পরিবর্তনের সময় শুরু হয়ে গেছে। পরিবর্তন পরিষ্কারভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের উপরে বিশ্বাস ফিরে আসবে
লেখক: টম নিকোলস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক এবং দ্য ডেথ অফ এক্সপার্টিসের লেখক

আমেরিকা বেশ কয়েক বছর ধরে মৌলিকভাবে অসচেতন দেশে পরিণত হয়েছে। এটি আমাদের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও উচ্চস্তরের ভোক্তা প্রযুক্তির দ্বারা বিলাসিতা এনে দিয়েছে। পারমাণবিক যুদ্ধ, তেলের ঘাটতি, উচ্চ বেকারত্ব, আকাশচুম্বী সুদের হার প্রভৃতি বিষয়, যা এক সময় আমাদের খুব ভাবিয়েছিল। এখন সেগুলি নিয়ে আমারা আর ভাবি না। সন্ত্রাসবাদ এক ধরণের ধারণামূলক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার জন্য আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবীদের মাতৃভূমির অগ্রণী প্রহরী হিসেবে মরুভূমির সুদূর কোণে প্রেরণ করেছি।

এমনকি আমরা এমন একজন টিভি স্টারকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেছি, যিনি আমলাতন্ত্রকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করেন এবং প্রতিদিন তার পরিকল্পনা ঠিক করেন। কোভিড-১৯ সঙ্কট এক্ষেত্রে দু’টি উপায়ে পরিবর্তন করতে পারে।

প্রথমত, এটি ইতিমধ্যে লোকজনকে বিশেষজ্ঞদের দক্ষতার বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। কোনো মহামারী আসার আগ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের দিকে চোখ রাঙানো সহজ ছিল।

দ্বিতীয়ত, এটি সম্ভবত আমেরিকানদের নতুন করে সচেতন করে তুলবে। কমপক্ষে তাদের এই ধারণার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে যে, সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমেরিকানদের সুস্থ রাখতে এবং মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচুর ব্যর্থতা জনসাধারণকে আবেগে ভাসার বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবে।

ধর্মীয় উপাসনায় ভিন্নতা আসবে
লেখক: অ্যামি সুলিভান, স্ট্রাটেজি ফর ভোট কমন গুডের পরিচালক

ভয়কে দূরে ঠেলে অনেক খৃষ্টান বলে থাকেন আমরা ইস্টার মানুষ। তবে ইস্টার লোকেরা তাদের পবিত্রতম দিনটি কীভাবে পালন করবে, যদি তারা ইস্টারের সকালে সবাই একসঙ্গে আনন্দ করতে না পারে? কিভাবে ইহুদিরা দাসত্ব থেকে তাদের মুক্তির দিবস উদযাপন করবেন?

তারাবিহ নামাজের জন্য স্থানীয় মসজিদগুলিতে যেতে না পারলে বা উপবাস ভাঙতে প্রিয়জনদের সঙ্গে জড়ো না হলে মুসলিম পরিবারগুলি কিভাবে রমজান উদযাপন করবে? কিংবা একত্রে নামাজ পড়তে না পারলে কিভাবে ঈদ উদযাপন হবে?

সবগুলি ধর্মই যুদ্ধ, গণহত্যাসহ বিভিন্ন সময়ে তাদের বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু সবগুলি ধর্ম একসঙ্গে এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আগে কখনো পড়েনি। একত্রিত হওয়া সব ধর্মগুলির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সেই বিষয়টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই পরিস্থিতির কারণে ধর্মীয় উৎসব পালনের রীতিতেও বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে। তথ্যসূত্র: পলিটিকো

 

টাইমস/এনজে/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইন্টার মিলানকে হারিয়ে শেষ আটে ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্স Jul 01, 2025
img
জামায়াত ক্ষমতায় এলে হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে : রফিকুল ইসলাম Jul 01, 2025
img
গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার ৯ বছর আজ Jul 01, 2025
img
বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষ শহর বাগদাদ, ঢাকার অবস্থান ১৪তম Jul 01, 2025
img
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস Jul 01, 2025
img
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় প্রাণ গেল ৯৫ জনের Jul 01, 2025
img
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩১.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার Jul 01, 2025
img
এনবিআর আন্দোলন: উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে প্রজ্ঞাপনের মিল নেই Jul 01, 2025
img
দেশের ৮ জেলায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস Jul 01, 2025
img
মুন্সীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ১ জনের Jul 01, 2025
img
বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভোটের অধিকার ফেরত পায়নি : অমিত Jul 01, 2025
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে স্মৃতি চারণ করলেন রুহুল কবির রিজভী Jul 01, 2025
জুলাই কর্মসূচিতে থাকবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বার্তা, জানালেন রিজভী Jul 01, 2025
১০ মিনিটে সারা বিশ্বের সর্বশেষ খবর Jul 01, 2025
শান্তর ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে যা বললেন বিসিবি সভাপতি Jul 01, 2025
img
চুলের যত্নে ঘরেই তৈরি করুন প্রাকৃতিক সিরাম Jul 01, 2025
img
কুড়িগ্রামে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার Jul 01, 2025
img
নরসিংদীতে আট মামলার আসামিকে হত্যা Jul 01, 2025
img
রাজশাহী সিটির নতুন অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত Jul 01, 2025
img
রাজধানীতে ব্র্যাক শিক্ষার্থীর আত্মহনন Jul 01, 2025