বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ও দুটি প্রস্তাব

বাংলাদেশ খুব ভাগ্যবতী। কারণ তার বুকে বেড়ে ওঠা তরুণরা এই দেশটার জন্য কিছু করতে চায়। সরকারের উচিত এই তরুণদের আগ্রহ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্দিনে দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করা বাংলাদেশী চিকিৎসক ও গবেষকরা আজ মাতৃভূমি নিয়ে চিন্তিত। কারণ বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস এখন লাল সবুজের দেশে।

প্রিয় জন্মভূমির পরিস্থিতি এখন অস্বাভাবিক। বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বাস্তবিকভাবে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়বে। জানি না পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি কথা বলতে গিয়েও বলা হচ্ছিল না। ভেবেছিলাম বলবো না। কিন্তু বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা কেমন হবে তা ভেবে চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। আর তাই আমার এরই যৎসামান্য কথাগুলো বলা।

আমার মা বাবা দুইজনেই বৃদ্ধ। তাদের ইমিউনো সিস্টেম কোভিড-১৯ কে প্রতিহত করতে পারবে বলে মনে হয় না। ষোলো কোটি মানুষের বাংলাদেশে আমার মা বাবার বয়সী যারা আছেন শুধু তাদের কথা চিন্তা করলেই শরীর হিম হয়ে আসে। ভাবতেও চাই না সেই আসন্ন ভয়াবহতার চিত্র।

যদিও কোভিড-১৯ শুধু বৃদ্ধদের জন্য আতঙ্কের নয়। বরং তা যেকোন বয়সের মানুষের ইমিউনো সিস্টেমকে দুর্বল করে দিতে পারে। যা করোনা আক্রান্ত অনেক রোগীর ক্ষেত্রে প্রমাণিত। এছাড়া কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের দেশে এক ধরণের কথা ছড়িয়েছে, গরম এবং হাই হিউমিডিটিতে কোভিড-১৯ টিকে থাকতে পারে না। আমি বলি, আপনারা ভুলের মধ্যে আছেন। এসব কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।

আপনারা জানেন, বাংলাদেশের অনেক গবেষক এবং ফ্রন্ট লাইনের মেডিকেল প্রফেশনাল আছেন, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাইরাস নিয়ে অনেক উঁচু মানের গবেষণা করছেন। কোভিড-১৯ এর আগে বেশকিছু ভাইরাস বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যেমন- সার্স, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু (এইচ-১ এন-১ ইত্যাদি। বাংলাদেশের অনেক গবেষক কোভিড-১৯ এর আগে আবির্ভূত এসব ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এসব ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বাংলাদেশী গবেষকদের নামও ইতিহাসে লেখা হয়ে আছে। আমি সেসব বাংলাদেশী গবেষকদের সম্পর্কে জানি। কিন্তু তাদের নাম আমি আজ এখানে উল্লেখ করলাম না।

বাংলাদেশী গবেষকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাম করলেও এতদিন বাংলাদেশ সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা খাতের গবেষণায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেনি। এমনকি এই খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে বলে হয়তো সরকার মনেই করে না। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়। পৃথিবীর অনেক দেশই স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা খাতের গবেষণাকে ‘আকাম’ বলে মনে করে। অধিকাংশ দেশের সরকারই মনে করে, চিকিৎসা খাতে গবেষকরা যে গবেষণা করে, তা কোন কাজে আসে না। অনেকেই মনে করে, চিকিৎসকরা গবেষণার নামে শুধু দেশ-বিদেশে কনফারেন্স করে বেড়ায়।

আমি মনে করি, এই সব লোকদের জন্য কোভিড-১৯ একটি বিষয় প্রমাণ করতে পেরেছে। যারা আগে চিকিৎসকদের গবেষণাকে অমূলক মনে করতেন, তারা এখন বলছেন- কিছু মানুষ গবেষণা করে যাচ্ছেন বলেই পৃথিবী এখনো তার সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। চিকিৎসা গবেষকদের প্রচেষ্টা ও সফলতার ফলেই আজ মানুষ কঠিন বিপর্যয়েও ঠিকে থাকতে পারছে।

কাজেই বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রুখতে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। আর এই ভাবনার সঙ্গে আমি দুটি প্রস্তাব সরকার বরাবর রাখতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাব দুটির যেকোন একটি গ্রহণ করলে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি খুব বেশি নাজুক হবে না।

প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী চিকিৎসকদের (গবেষণায় নিয়োজিত) দেশে ফিরিয়ে আনা। এরপর একটি সমন্বিত টিম তৈরি করে তাদেরকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত করা। সেই সঙ্গে গবেষণা এগিয়ে নেয়া। আমি মনে করি, সরকার যত দ্রুত এই কাজটি করতে পারবে, তত দ্রুতই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে আসবে।

দেখুন, আমি নিজেও একজন গবেষক। আমার কাজ ভাইরাস নিয়ে নয়, ক্যান্সার নির্ণয়ের কাজ করি আমি। তারপরও আমার কাজের অভিজ্ঞতা ও কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আমি এটুকু বলতে পারি, খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কোভিড-১৯ এর জন্য একটি র‌্যাপিড ডিটেকশন পদ্ধতি তৈরি করা সম্ভব।

সরকার যদি মনে করে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী গবেষকদের তারা দেশের কাজে লাগাবেন, তবে সব ডাক্তাররাই এ ব্যাপারে সম্মত হবেন। কারণ সবার আগে আমার দেশ ও দেশের মানুষ। কাজেই সরকার চাইলে বাছাইকৃত চিকিৎসক ও গবেষকদের দেশে নিয়ে এসে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে নিতে পারে।

আমি মনে করি, এই কাজের জন্য বেশি লোকের দরকার নেই। মাত্র ১০ জন দেশপ্রেমিক তরুণ গবেষক ও চিকিৎসক হলেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। যে তরুণরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই স্পিরিট নিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় মাঠে নামবে।

সরকারের কাছে আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব। আমাদের দেশের যত ওষুধ কোম্পানি আছে তাদের প্রধানদের ডাকুন। তাদেরকে বলুন, কোম্পানিগুলো যেন তাদের সবচেয়ে মেধাবী গবেষকদের এই মুহূর্তে দেশের কাজে ব্যবহার করে। কারণ এই কোম্পানিগুলোর অনেক মেধাবী গবেষক আছেন। যারা ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট ও ইনফেকশাস ডিজিজ নির্ণয় নিয়ে গবেষণা করছেন। আর তাদের এ ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এছাড়া যারা ইনফেকশাস ডিজিজের এপিডেমিওলজি ভালো বুঝেন এবং জানেন, তাদেরকেও কাজে লাগান। আমি বিশ্বাস করি ওষুধ কোম্পানিগুলো এই উদ্যোগ সহজে গ্রহণ করবে।

কাজেই সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি এই প্রস্তাব দুটি বিবেচনায় নিন। মনে রাখবেন, এই ভাইরাস বাংলাদেশকে এত সহজে ছাড়বে না। আপনারা যদি ভেবে থাকেন অন্য কোন দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করবে, আর আপনারা সেই ভ্যাকসিন দেশে নিয়ে এসে মানুষের চিকিৎসা করবেন, তাহলে আপনার এখনো ভুলের মধ্যেই আছেন। আর তাই দেরি না করে, দেশের গবেষকদের কাজে লাগান। দেশ ও দেশের মানুষকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করুন।

 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া

Share this news on: