ভেবে দেখুন সাংবাদিকহীন পৃথিবীটা কেমন হবে

করোনাভাইরাসের কারণে মারা যাওয়া ব্রিটিশ নাগরিকের সংখ্যা, ১৯৪৫ সালের পর থেকে সৃষ্ট সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে নিহতের থেকেও বেশি । তবে, এর (করোনাভাইরাসের) কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে।

তা হলো- বিনামূল্যে বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে। এটি বিজ্ঞান, ওষুধ ও জেনোম-ম্যাপিং কতটা মূল্যবান তা প্রমাণ করেছে। এছাড়াও এটি আমাদেরকে দেখিয়েছে, সাংবাদিকতা না থাকলে আমাদের মধ্যে আরও অনেক লোককে প্রাণ হারাতে হতো।

সরকারের ঘরে থাকার বার্তা যদি ব্যাপকভাবে প্রচার করা না হতো, তাহলে কোনো ওষুধেই এত প্রাণ বাঁচানো সম্ভব ছিল না। সবকিছুর পরেও আরও বেশি লোক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশের সবটাই উপেক্ষা করতেন, যদি করোনায় মৃত ব্যক্তিদের ছবি ও স্টোরি ব্যাপকভাবে প্রচার না হতো।

এই গুরু দায়িত্ব পালন করেছে দ্যা গার্ডিয়ান, দ্যা সান, দ্যা ডেইলি মেইল, দ্যা টেলিগ্রাফ, দ্যা এক্সপ্রেস, বিবিসি, চ্যানেল ফোর, স্কাই নিউজ, আল জাজিরা, আইটিএনসহ শত শত স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছে সব সংবাদ, বিশ্লেষণ, গবেষণা ও সমীক্ষার তথ্য। এর জন্য প্রায় ৬৪ হাজার সংবাদকর্মীকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যাদেরকে আপনি খুব সহজেই ভুলে যাবেন কিংবা যাদের অবদান কখনোই ভেবে দেখেননি।

এদের মধ্যে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, সাব-এডিটর, প্রযোজক, উপস্থাপক, ফ্লোর ম্যানেজার, ক্যামেরা অপারেটর, সাউন্ড টেকনিশিয়ান, প্রিন্টার, ডিজাইনার, শিল্পী এবং অন্য অনেক লোক অন্তর্ভুক্ত, যারা বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা খুঁজে বের করেছিলেন।

যখন চীনা কর্তৃপক্ষ ভুল তথ্য প্রকাশ করছিল এবং তার পুনরাবৃত্তি করছিল, তখন সাংবাদিকতা উহানের প্রাদুর্ভাবকে ঘিরে নীরবতার প্রাচীরকে গুড়িয়ে দিয়েছে। এটিই সাংবাদিকতা, যা এসব মিথ্যার প্রভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে তা তুলে ধরেছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়াতেও মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছিল, সেখানেও সত্য উন্মোচন করছে সাংবাদিকতা।

সাংবাদিকতা যাই প্রকাশ করে না কেন, এটি খসড়া তৈরি করে, তদন্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত তা নিশ্চিত করে। এটি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে।

সাংবাদিকতা না থাকলে এখনও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মজুদ চলত, এমনকি লুটপাটও শুরু হয়ে যেত। পুলিশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হতো। সৈকতে লোকজন ভ্রমণ করে বেড়াতো, কাগজে বা সন্ধ্যার খবরে কখনও তাদের কথা বলা হতো না। এতে করে সংক্রমণ ছড়াতে থাকত এবং আরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারত।

আমরা নিখুঁত নই। আমরা আপনার প্রিয় মানুষ নই। আমরা কখনও আপনার ধন্যবাদ দাবি করি না; আমরা কেবল চাই আপনি নিজে আপনার ভাবনাগুলি শুনুন।

আমার মেয়ের একটি গল্পের বই রয়েছে, যা দ্য স্টোরি অফ অ্যাভ্রিথিং নামে পরিচিত। এটি বিগব্যাং দিয়ে শুরু হয় এবং ব্যাকটেরিয়া, ডাইনোসর, অ্যাপস, কৃষি ও শিল্পের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন পর্যন্ত যায়। বইয়ের পাতায় আকাশছোঁয়া কাঁচের দালানকে জায়গা ছেড়ে দিতে থাকা মাটির বাড়িঘর এবং একটি খাল দিয়ে কারখানার দিকে যেতে থাকা জাহাজের ছবি রয়েছে। জাহাজে ‘কাগজ’ ও ‘কালি’ লেবেলযুক্ত বাক্স আছে এবং কারখানায় রয়েছে একটি প্রিন্টিং প্রেস।

একটি প্রজাতি হিসেবে আমাদের বিকাশের সঙ্গে সাংবাদিকতা হাতেহাত রেখে চলেছে। লেখা, ভাগাভাগি করা, গসিপ করা, লজ্জা, অন্যকে জানানো এবং এগুলি সমস্তরূপে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমাদের বিকশিত হতে সহায়তা করে।

২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুনামি কাভার করার সময় আমি এবং ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ক্যাসি বার্মায় গিয়েছিলাম। আমরা শুনেছি, ব্রিটিশ ব্যাকপ্যাকাররা ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় দু’দিনের জন্য থাই সীমান্তের ওপারে আটকে ছিল এবং সম্ভবত তরঙ্গের কবলে পড়েছে। নদীর তীরে যাওয়ার জন্য আমরা একটি নৌকা, একজন অনুবাদক এবং কিছু স্থানীয় লোককে পেয়েছিলাম। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা কি তরঙ্গটিকে দেখতে পেয়েছিলেন? আপনারা কি এখানে কোনো বিদেশীর সম্পর্কে জানেন?

বার্মিজরা তাদের গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির সম্পর্কে জানত। তারা তাদের জাতি, তাদের অঞ্চল, তাদের সরকার, এমনকি নিকটতম শহর সম্পর্কেও তেমন কিছুই জানত না। এটি ছিল আর্কিডিয়ান, প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা। সেখানে কোনো সাংবাদিকতা ছিল না এবং জ্ঞান, যাচাই-বাছাই, গণতন্ত্র বা এমন হাজার হাজার বিষয় সেখানে অনুপস্থিত।

অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, সাংবাদিকতা একটি সমস্যা। এই অভিযোগ করেন সন্ত্রাসী, রাজনীতিবিদ, অপরাধী, গোপনীয়তা প্রচারকারী ও সেলিব্রেটিরা। তাদের কারো কারো জন্য সাংবাদিককে আক্রমণ করা, শিরোনাম হওয়ার, বিক্রি বৃদ্ধি করার এবং সমর্থক বৃদ্ধির নিশ্চিত উপায়। সাংবাদিকদের প্রশংসা করে একটি টুইট হলে হাজার হাজার উদ্দেশ্য প্রণোদিত টুইট করা হবে সাংবাদিকরা কতটা নোংরা হতে পারে তা প্রমাণ করার জন্য।

আমি আপনাকে একটি গোপন কথা বলি: একজন সাংবাদিককে অন্য একজন সাংবাদিকের থেকে বেশি ঘৃণা অন্য কেউ করেন না। আপনি সাংবাদিকদের কুকীর্তি সম্পর্কে যত খবর জানেন তা অন্য কোনো সাংবাদিকের দ্বারাই প্রকাশিত হয়েছে। এটাই আমাদের শক্তি: আমাদের পক্ষপাতও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ।

সাংবাদিকতা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে এবং উন্নত করেছে। তবে, তা প্রমাণ করার উপায় নেই। সুতরাং আসুন আমরা বলি যে; চিকিৎসা, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও রাজনীতির পাশাপাশি আমরা শুধু আমাদের কাজটা করেছি। এই কারণেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের তালিকায় রয়েছি এবং এ জন্যই সাংবাদিকরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাংবাদিকরাও যুদ্ধের ময়দানে রয়েছেন, এ কারণেই আপনি জানেন যুদ্ধের অস্তিত্ব রয়েছে।

বিদ্রূপের বিষয় এই যে, করোনাভাইরাস টেলিভিশনের আবির্ভাবের চেয়েও সাংবাদিকতাকে আরও বড় হুমকি এবং সুযোগের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

রোগ এবং এর নিরাময়ের খবর শুনতে বিশ্ব মরিয়া। একইসঙ্গে মজার মুখ ওয়ালা কুকুর সম্পর্কে শুনতেও মানুষ সমান আগ্রহী। অর্থনৈতিক দুর্ঘটনার মুখোমুখি ব্যবসাগুলির নতুন কাস্টমার পাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া দরকার। সংবাদ মাধ্যম সে টিভি, রেডিও, অনলাইন বা মুদ্রণ হোক না কেন তাদের নিজস্ব দর্শক-শ্রোতা-পাঠক রয়েছে।

অন্যদিকে, বিজ্ঞাপনের আয় হ্রাস পেয়েছে। কারণ, ব্যবসায়ীরা ব্যয় করতে চাইছেন না। কেউ কেউ করোনাভাইরাসের স্টোরির জনপ্রিয়তা উপেক্ষা করে এর পাশে বিজ্ঞাপন দিতে অস্বীকার করছেন। লকডাউন চলাকালীন টিভি এবং অনলাইন দর্শক ও পাঠকের পরিমাণ বেড়ে গেলেও এটি প্রিন্ট মিডিয়াকে ডুবিয়েছে। কারণ, খুব কম লোকই এখন পত্রিকা কিনছেন। দুটি বড় বড় সংবাদপত্র করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, আরও কয়েকটি লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। স্টাফদের ছুটি দেয়া হয়েছে এবং তাদের বেতন কাটা হয়েছে, তবুও তারা যুদ্ধের ময়দানে আছেন, কারণ যুদ্ধ এখনো চলছে।

যদি বিজ্ঞাপনদাতারা সাংবাদিকতার জন্য অর্থ প্রদান করেন, তাহলে বুঝতে হবে কমপক্ষে সমস্ত সাংবাদিকতা বিবিসি হয়ে যায়নি। যদি বিবিসি আমাদের একমাত্র মাধ্যম হতো, তবে সেটা মোটেও ভালো কিছু হতো না।

এতক্ষণ ধরে এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হলো: অন্তত একটি কাগজ কিনুন। সংবাদ উপস্থাপককে ধন্যবাদ দিন। নিজেকে প্রশ্ন করুন যে, কতগুলি মানুষ তাদের উপর নির্ভর করে? কোনো প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যম থেকে আপনি কতবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু শেয়ার করেছেন তারও হিসাব করুন।

চিকিৎসক, সেবাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী সবাই আমাদের সাধুবাদের দাবিদার। সাংবাদিকরা কারো সাধুবাদ পেতে চায় না। আমরা কেবল কখনো কখনো আপনাকে ভাবাতে চেয়েছি, আজ আমরা আবারও আপনাকে চাইবো। আপনি ভেবে দেখুন, আমাদের ছাড়া আপনার পৃথিবী কতটা শূন্য হয়ে যাবে। তথ্যসূত্র: মিরর.কম

লেখক: কলামিস্ট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : নাবিল জাহাঙ্গীর

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কুমিল্লায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ Nov 16, 2025
img
পুলিশকে কামড়ে পালিয়েছেন ছাত্রদল নেতা Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনার রায় আগামীকাল, সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি Nov 16, 2025
img

বাংলাদেশ দূতাবাস, মানামা

বাহরাইন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্পের আয়োজন Nov 16, 2025
img
ভোটারদের কেন্দ্রে আনা ও নিরাপদ নির্বাচনি পরিবেশের জন্য দলগুলোর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ: সিইসি Nov 16, 2025
img
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে সবুজায়ন করবে ডিএনসিসি Nov 16, 2025
img
১৫০ কিমি গতিতে বোলিং করতে পারি: শাহীন আফ্রিদি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ এক পা এগোলে, পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে আসবে: মাওলানা ফজলুর Nov 16, 2025
img
যুক্তরাজ্যে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে সময় লাগবে ২০ বছর! Nov 16, 2025
img
যারা একসময় মজলুম ছিল, তারা এখন জালিম সাজছে: তথ্য উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
মিঠুনদা আমার বাবার মতো: দেব Nov 16, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই শাহরুখকে কিং করেছে: শিল্পা শেট্টি Nov 16, 2025
img
ইরান ভয়াবহ সংকটে, মসজিদে দোয়া Nov 16, 2025
img
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী আহত Nov 16, 2025
img
অনিয়মের প্রমাণ পায়নি বিসিবি Nov 16, 2025
img
বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ: সেলিমা রহমান Nov 16, 2025
img

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬টি দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শুরু Nov 16, 2025
img

মো. ফখরুল ইসলাম

‘তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে নোয়াখালী হবে সিঙ্গাপুর’ Nov 16, 2025
img
সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মধ্যরাতে আগুন Nov 16, 2025
img
স্কুলের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে আসি: সোনাক্ষী সিনহা Nov 16, 2025