ইতিহাসের পাতায় পাতায় চিকিৎসকদের অবদান

মোঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা মমতাজ বেগমের গর্ভে জন্ম নেয়া জাহানারা ছিল পিতার ভীষণ প্রিয়। সুন্দরী বিদুষী কন্যা পিতাকে রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন। তার গুণে-বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ পিতা তার উপাধি দিয়েছিলেন মালিকা-ই-হিন্দুস্তান পাদিশাহ বেগম, রাজ্যের বিষয় আশয়ে কন্যার ছিল ব্যাপক প্রভাব। এ যুগের মেলানিয়া ট্রাম্প হয়তোবা বলা যেতে পারে।

১৬৪১ সালের এক সন্ধ্যায় অন্দরমহলের প্রধান ২৭ বছর বয়সী রাজকুমারী জাহানারা পিতার প্রাসাদ থেকে যখন নিজের মহলে ফিরছিলেন তখন তার সুগন্ধী মসলিন কাপড়ের প্রান্ত প্রদীপে লেগে গায়ে আগুণ ধরে যায়। সঙ্গীয় সখী ও দাসীরা আগুণ নিভাতে গেলে আরো ছড়িয়ে যায় এবং দুজন মারা যায়। জাহানারা কোনরকমে প্রাণে বাঁচলেও সকলে বেঁচে ফিরার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহান হেকিমদের দিয়ে গ্রীক ও ভারতীয় যত ঔষধ ছিল তা থেকে মলম তৈরি করে কন্যার ক্ষতস্থানে লাগালেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠার লক্ষণ ছিল ক্ষীণ।

এমন সময়ে সম্রাট জানলেন সুরাটের বন্দরে নোঙ্গর করা ব্রিটিশ জাহাজ এইচ.এম.এস হোপওয়েলে গ্যাব্রিয়েল বাউটন নামে একজন ভাল ইংরেজ চিকিৎসক রয়েছেন। সম্রাটের তলবে হন্তদন্ত হয়ে আগ্রার প্রাসাদে আসলেন বাউটন। বাউটনের চিকিৎসায় দ্রুত কাজ হল। সম্রাট আর রাজকন্যা দুজনেই ভীষণ খুশী হয়ে বাউটনের কাছে জানতে চাইলেন বিনিময়ে তিনি কি চান। বাউটন নিজের জন্য কিছুই চাইলেন না, তিনি চাইলেন মাতৃভূমির জন্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বিনাশুল্কে ভারতে ব্যবসার অনুমতি আর বাংলায় ফ্যাক্টরি করার অনুমতি। সম্রাট নামমাত্র মাশুলে তা মঞ্জুর করলেন। ১৬৩২ সালে পর্তুগীজদের হুগলী থেকে বের করে দেয়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গে ব্যবসার যে ফাঁক তৈরি হয়েছিল ইংরেজরা এরপর ধীরে ধীরে তা দখল করে নেয়, অতঃপর পাটনা ও কাশিমপুরেও কারখানা ও ব্যবসা বাড়ায় কোম্পানি।

সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বার্ষিক ৩০০০ রুপীর বিনিময়ে প্রায় বিনা শুল্কে ব্যবসা করত। কিন্তু অসুবিধা ছিল মোঘল প্রাদেশিক গভর্নররা তা মানতেন না। কোম্পানির সাথে প্রাদেশিক গভর্নরদের বিবাদ লেগেই থাকত। এর ফলে কোম্পানির বাণিজ্য যথেষ্ট নিরাপদ ও স্থিতিশীল ছিল না। কোম্পানি এজন্য মোঘল সম্রাটের দরবার থেকে সারা ভারতে ব্যবসার জন্য একটি শাহী ফরমানের জন্য উদগ্রীব ছিল, যেটি তাদের প্রাদেশিক গভর্নরদের হাত থেকে মুক্ত করে নিরাপদে ব্যবসা চালাতে সাহায্য করবে।

১৭১৩ সালে ফারুখসিয়ার মোঘল সম্রাট হলে কোম্পানি ভীষণ উৎসাহিত হয় কারণ তারা জানত ফারুখসিয়ার ইংরেজদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। ১৭১৫ সালে কোম্পানি কলকাতা থেকে জন সুরম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় আগ্রায়। এই দলে ছিলেন ইংরেজ চিকিৎসক উইলিয়াম হ্যামিলটন। সম্রাটের তখন রাজপুতানার মেয়ে ইন্ধিরা কানওয়ারের সাথে বিবাহের প্রস্তুতি চলছিল। হঠাৎ সম্রাট ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজ্যের কোন হেকিমই সম্রাটকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলনা। এ সময় ইংরেজ প্রতিনিধিদলের সেই চিকিৎসক হ্যামিলটনের ডাক পড়ল। তার প্রাণান্ত চেষ্টায় সম্রাট সেরে উঠলেন এবং বিয়েটা সেরে নিলেন। কৃতজ্ঞ সম্রাট ১৭১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিকে হায়দ্রাবাদ, আহমেদাবাদ ও বাংলায় বাণিজ্যিক সুবিধা দেন। কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুরের উপর কোম্পানির জমিদারী অধিকার মেনে নেন। এছাড়া কলকাতার আশেপাশে আরো ৩৮টি গ্রাম জমিদারদের কাছ থেকে কিনে নেয়ার অনুমতি দেন। যদিও এ নিয়ে সুবেদার মুর্শিদকুলী খানের সাথে বিবাদ শুরু হয়েছিল কোম্পানির।

অটোমান সাম্রাজ্য:

১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ডে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ দুর্ভিক্ষ সাত বছর জুড়ে ছিল। দুর্ভিক্ষের মূলে ছিল ফাঙ্গাস জনিত কারণে আলুর ফলন না হওয়া। এর নাম ছিল পটেটো ব্লাইট। আইরিশদের খাদ্যাভাসে আলুর রয়েছে এক বিশাল স্থান। আলুর ফলন না হওয়ায় আয়ারল্যান্ডে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এর ফলে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায় আর ১০ লক্ষ মানুষ গত্যান্তর না দেখে জাহাজে চড়ে আমেরিকা চলে যায়। সেই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনভার ছিল ৩১ তম সুলতান আবদুল মেজিদ-১ এর হাতে। সুলতান মাত্র কদিন হল ক্ষমতায় এসেছেন। নিজের রাজ্যের অবস্থাও তখন সঙ্গীন।

জেমস ম্যাক্রেইথ নামে সুলতানের তখন এক ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। জাতিতে তিনি আইরিশ। সুলতান তার কাছে শুনতে পান আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, তার আহ্বানে সাড়া দেন সুলতান। কথিত আছে, ম্যাক্রেইথের গোটা পরিবার এই দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সুলতান ১০,০০০ পাউন্ড দিয়ে আইরিশদের সাহায্য করতে চাইলেন। যার বর্তমান মূল্য ১.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু সমস্যা বাঁধাল ব্রিটিশরা। তখন তাদের হাতে আয়ারল্যান্ডের শাসনভার। তাদের দাবী হল সুলতান কোনভাবেই রাণী ভিক্টোরিয়ার চেয়ে বেশী সাহায্য করতে পারেন না। কারণ এতে রাণীর অপমান হয়। রাণী তার ভাণ্ডার থেকে ২৫০০ পাউন্ড দিয়েছিলেন। ইস্তাম্বুলের ব্রিটিশ প্রতিনিধির পরামর্শে ২৩ বছর বয়সী সুলতান দিলেন ১০০০ পাউন্ড আর গোপনে ৫টি জাহাজে করে পাঠানো হল খাদ্যদ্রব্য। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নজরদারির কারণে অটোমান জাহাজ ডাবলিনে নামতে পারলনা। দূরের আইরিশ বন্দর ড্রোগেদায় খালাস করতে হল জাহাজ বোঝাই খাদ্যদ্রব্য। আজো ড্রোগেদা শহরের সর্বত্র অটোমানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রয়েছে চাঁদ তারা খচিত প্রতীক।

জার্মান সাম্রাজ্য:

১৯০৪ সাল, ৩২ বছর বয়সী এডুয়ার্ড ব্লচ তখন এডলফ হিটলারের পারিবারিক ডাক্তার। যদিও ব্লচ ছিলেন অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেয়া এক ইহুদী। ছোট্ট এডলফ হিটলার ফুসফুসের অসুখে তখন বিছানায় শয্যাশায়ী, স্কুল ত্যাগ করতে হয়েছিল এই কারণে। ব্লচের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন হিটলার। ১৯০৭ সালে হিটলারের মা ক্লারা হিটলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ব্লচ আপ্রাণ চেষ্টা করেন বাঁচাতে। হিটলার পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে ব্লচ খুব কম অর্থ নিতেন তাদের কাছ থেকে। অনেক সময় নেননি। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ১৯০৮ সালে হিটলার পোস্ট কার্ড পাঠান ব্লচকে, নিজ হাতে তৈরি গিফটও দেন। ১৯৩৭ সালে এত ঢামাডোলের মধ্যেও প্রিয় সেই চিকিৎসকের খোঁজ নিতে ভুলেননি। তিনি তাকে নোবেল ইহুদী হিসেবে অভিহিত করেন। লিঞ্জ শহরে গেস্টাপো বাহিনী ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও ব্লচকে আলাদা খাতির যত্ন করত। যা ছিল বিরল ঘটনা।

সমগ্র জার্মানিতে ইহুদীদের প্রতি বিরূপ এক সমাজ তৈরি হওয়ায় ১৯৩৮ সালে ব্লচের মেডিকেল প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে গেলে তিনি হিটলারের কাছে দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার আবেদন জানিয়ে এক চিঠি প্রেরণ করেন। হিটলার ব্লচের বাড়ি সমেত যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে চলে যাওয়ার সুযোগ দেন। এমনকি বিক্রিলব্ধ অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ অনুমতি দেন। হিটলার মারা যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর ব্লচ নিউইয়র্ক শহরে মারা যান।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ডাকসুর ভোট ম্যানুয়ালি গণনার জন্য উমামার লিখিত আবেদন Sep 16, 2025
img

মাসুদ সাঈদী

জনগণের ভালোবাসা অর্জন করুন, তাহলে নির্বাচন বর্জনের দরকার হবে না Sep 16, 2025
img
আরও ১ মাস বাড়লো ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ Sep 16, 2025
img
আগস্টে ৪৯ মামলায় জড়িত ৩১১ দুর্নীতিবাজ Sep 15, 2025
img
১৫ কেজির কোরাল মাছ বিক্রি ১৮ হাজারে Sep 15, 2025
img
শ্রীলঙ্কার সামনে হংকংয়ের ১৫০ রানের চ্যালেঞ্জ Sep 15, 2025
img
নিকুঞ্জে নাগরিক জাগরণ: হারানো শান্তি ফিরে পাওয়ার গল্প Sep 15, 2025
img
সুপার ফোরে খেলবে বাংলাদেশ, আত্মবিশ্বাসী কোচ Sep 15, 2025
img
ম্যাচের আগে বাংলাদেশের প্রশংসায় জনাথন ট্রট Sep 15, 2025
img
অসুস্থ অমিতাভকে ২০০ জন ৬০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলেন Sep 15, 2025
img
অতিরিক্ত ৬ বছরের কারাভোগ শেষে ভারতে ফিরলেন রামাতা Sep 15, 2025
এশিয়া কাপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, সুপার ফোর নিশ্চিত কার? Sep 15, 2025
img
আলোচনা ভেস্তে দিতেই দোহায় হামলা : কাতারি আমির Sep 15, 2025
img
তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহী চীন, পাঠাচ্ছে কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল Sep 15, 2025
img
ভাঙ্গায় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, ক্ষতিগ্রস্ত ৮ গাড়ি ও ১৯ মোটরসাইকেল Sep 15, 2025
img

কাতারে হামলা

নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী Sep 15, 2025
img
দেশবাসী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন : জামায়াত সেক্রেটারি Sep 15, 2025
img
লেভেল ফোর কোচিং শেষ করলেন মঞ্জু Sep 15, 2025
img
ওমানকে হারিয়ে প্রথম জয় আমিরাতের Sep 15, 2025
img
বিসিবি নির্বাচনে খেলোয়াড় প্রতিনিধি চায় কোয়াব! Sep 15, 2025