“পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য কোনও এক শ্রেণীর দখলে থাকতে পারে না”

১৯৩৬ সালে লক্ষ্মৌতে আয়োজিত প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভায় সভাপতি বললেন, “সাহিত্য সেখানেই জন্ম নেয় যেখানে সত্যের প্রকাশ ঘটে। জীবনের সত্যময়তা ও অনুভূতিপ্রবণতা ভাষার হাত ধরে ব্যক্ত হলে সাহিত্যে পূর্ণতা আসে”। এ কথা বলার অধিকার বা আত্মবিশ্বাস সেই ব্যক্তির ছিল, কারণ নামটি তাঁর ধনপত রাই শ্রীবাস্তব ওরফে মুন্সী প্রেমচাঁদ (৩১শে জুলাই ১৮৮০ – ৮ই অক্টোবর ১৯৩৬)। ভারতবর্ষের সাহিত্যের বিস্তৃত যাত্রাপথে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসাবে যার অধিষ্ঠান। প্রাণবন্ত ভাষায় তিনি বিংশ শতকের জরাগ্রস্ত দেশের ভঙ্গুর কুঁড়েঘরে, নিস্তব্ধ মন্দিরের চাতালে, পূর্ণিমার আদর মাখা আখক্ষেতে, ক্লান্ত অবসন্ন চাষীর ঘাড়ের উপর কিংবা পোষ্যের চোখে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ক্যামেরায় উঠে আসা চিত্রাবলী তিনি নকশার মতো বুনেছেন পাঠকমনে। ব্যক্তিগতভাবে প্রেমচাঁদের লিখনশৈলীর সাথে পরিচিত হওয়ার আগে বেশ ছোটবেলায় তাঁর গল্পের উপর ভিত্তি করে একটি নাটক দেখেছিলাম। নাটক আরম্ভের আগে স্কুলের শিক্ষকের কথা এখনও কানে বাজে। বলেছিলেন, “সরস্বতীর কৃপা যাঁদের মাথার উপর থাকে, তাদের লেখা নির্বাসনে পাঠালেও বারবার ছিটকে বেরিয়ে আসে প্রতিভার জোরে, সেই লেখাকে শিকলে বাঁধা যায় না। এই নাটকটি যার গল্পের উপর রচিত, তার লেখা নির্বাসিত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর উপর সরস্বতীর কৃপা ছিল। মুন্সী প্রেমচাঁদ, নামটা ভুলো না”। বিশ্বসাহিত্যের দরজা খুলে যাওয়ার পর ভারতবর্ষের সাহিত্যিক ইতিহাসের সামনে যেটুকু ধর্ণা দেওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রেমচাঁদ যতবার আনাগোনা করেছেন, সাষ্টাঙ্গ সমর্পণ ছাড়া আর কোনও নৈবেদ্যের কথা মাথায় আসেনি।

রাজনৈতিক প্রতিবেদন লেখার সময় আগল একটু আলগা হয় তার; কিন্তু ধনিয়া, হরি মাহাতো, ঘিসু, মাধবদের আখ্যান বর্ণনার সময় কলম একবারের জন্যও লক্ষ্যচ্যুত হয় না। নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যে তিনি অসংখ্য বার বুঝিয়ে দেন এই দেশের প্রাণভোমরা আসলে কারা। কাদের শারীরবৃত্তি আর মনোবৃত্তি দেশের স্পন্দনকে ধরে রেখেছে। আসা যাওয়ার মাঝে তার চরিত্রেরা কথা বলে অফুরান। স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধারাবিবরণীর উল্টো পিঠে মানবতার নিরলস সাধনাই প্রেমচাঁদের সবচেয়ে জোরের জায়গা। এখানে কেউ তাকে বাধা দেওয়ার সাহস রাখে না, তার স্বচ্ছ সজাগ দৃষ্টির সামনে কেউ অর্ধস্বচ্ছ পর্দা টাঙাতে পারে না। গ্রাম আর শহরকে, মানুষকে অথবা পশুকে একসাথে নিয়ে তিনি সাহিত্যের অভয়ারণ্যে নিশিযাপন করেন। আবেগের আতিশয্যে ভেসে না গিয়ে গল্পের বুনোটেই আবেগের অতিরেককে নিয়ন্ত্রণ করেন। পাঠক কাঁদে, তিনি কাঁদেন না। কাঁদলে যে চোখ ঝাপসা হবে, ‘কাফন’ পেরিয়ে ‘পুস কি রাত’-এর আখ্যান তবে তিনি লিখবেন কেমন করে?

‘পুস কি রাত’ (১৯৩০); সেই অবিস্মরণীয় আলেখ্য যেখানে মনিব আর পোষ্য মিলে সম্পর্কের চেনা ছককে সজোরে ধাক্কা দেয়, দিতেই থাকে। মানুষে মানুষে কথোপকথনের গণ্ডীর বাইরে এসে লেখক হাড়কাঁপানো শীতের রাতে চাষজমির ধারে একটা চৌকি পাতেন। সেই চৌকির উপরে শুয়ে রয়েছে হালকু, তলায় তার সঙ্গী কুকুর জাবরা। ঠাণ্ডার প্রাবল্য যত বাড়ে, ততই উষ্ণতায় ভরে ওঠে জাবরা-হালকুর কথা চালাচালি। জাবরার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে তার মনিব বলে, “কাল থেকে আর আমার সাথে আসবি না, নয়তো তোর সারা শরীর এই ঠাণ্ডায় জমে যাবে”। জাবরা ডাকে, কখনও মৃদু স্বরে, কখনও বা উচ্চৈঃস্বরে। হালকু আর তার পোষ্যের মাঝখানে তন্দ্রাবিহীন চোখ মেলে উপস্থিত আছেন গল্পকার। তিনি আছেন বলেই জাবরার কোন্ ডাকের কী মানে আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না।

প্রেমচাঁদ তপ্ত পিচে পা ফেলেন, খরার পর ফুটিফাটা ক্ষেতের ভিতর স্বচ্ছন্দে পায়ের পাতা রাখেন, পা রক্তাক্ত হয় তার। তবু কলম আহত হয় না। এমন সাবলীল তার চলন যে ইতিহাসের আয়নার সামনে জোর করে তার কাহিনীকে দাঁড় করাতে হয় না। তিনি তো লিখছেন এক অন্য ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস। তার কষ্ট হয়, সমস্যার সমাধান নিজে খুঁজে পান না। তিনি কেবল আপামর মানুষের রোজনামচার নথিকরণ করে যেতে পারেন। সেটাই নিঃস্বার্থভাবে করে গিয়েছেন। কারণ, “সত্যিকারের শিল্পী স্বার্থমগ্ন হতে পারেন না। মনোতুষ্টির জন্য শিল্পীর দেখনদারির আবশ্যকতা নেই”। সমাজের আরোপিত নিয়মাবলীর ফাঁসে জীবন চলবে একদিকে, আর সেই জীবনের স্বল্পায়ু কোনও ‘অবসরে’ কয়েক কণা সাহিত্য রচিত হবে- এমন দ্বিচারিতা তিনি মানেন না। সাহিত্য তার কাছে জীবনবৃত্তি। মানবতার ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভাষ্যপাঠের মাধ্যমে প্রেমচাঁদ শ্রমসাধ্য কুয়ো খনন করতেই থাকেন। শ্রেণীবৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার কাদায় মাখামাখি হয়ে যায় তার ‘ঠাকুর কা কূঁয়া’ (১৯৩২) গল্পের গঙ্গি-জোখু।

মরণাপন্ন স্বামী জোখুর জন্য জল আনতে অতি সন্তর্পণে ঠাকুরদের কুয়োতলায় পৌঁছেছে গঙ্গি। কিন্তু, সেখান থেকে জল নেবে কী করে? কেউ দেখতে পেলে যে প্রাণ যাবে। তবু সে মরিয়া হয়ে রাতের অন্ধকারে সুযোগের অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতে করতে তার মনে জেগে ওঠে শ্রেণীবৈষম্যের প্রারম্ভিক প্রশ্নটি। প্রেমচাঁদের কলম পৌঁছয় গঙ্গির হৃদয়ের সেই প্রকোষ্ঠে। সে ভাবে, “আমরা নীচু জাতি আর ওরা উঁচু জাতি হল কী করে? গলায় একটা সুতো জড়ালেই কেউ উঁচু জাতের হয়ে যায়?” ঠাকুর বা গ্রামের সাহুজী উঁচুজাতের হয়েও অনৈতিক উপায়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটায় কেন? গঙ্গি ভাবতে ভাবতে সন্দিহান হয়, প্রশ্নগুলোর উত্তর আসে না। এই ভাবনার আবহেই একেবারে নিঃশব্দে কুয়োর মধ্যে জলের পাত্র নামায় সে। প্রচণ্ড ভয় লাগছে তার, চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে রাখতে কাজ যখন প্রায় সারা, এমন সময়ে ঠাকুর সাহেবের ঘরের দরজা খুলে যায়। গঙ্গির হাত থেকে দড়ি ছেড়ে যায়, জলভরা পাত্র আওয়াজ করে আবার কুয়োতেই ফিরে যায়। ‘অধিকার-বহির্ভূত’ কাজে অসফল হয়ে গঙ্গি খালি পাত্র নিয়েই ঘরে ফেরে। কাহিনীর শেষটা সুখকর হয় না। কিন্তু, উঁচুজাতের ঠাকুর সাহেবের মুখে গল্পকার ‘কে রে, কে ওখানে’ ছাড়া আর কোনও সংলাপ বসান না, আর অস্পৃশ্য গঙ্গির ভাবনাকে তিনি দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেন। এই হলেন প্রেমচাঁদ। এখানেই আত্মিকতা থেকে সামাজিকতায় উত্তীর্ণ হয় তার ভাষাসাধনা।

প্রায় একশো বছর হতে চলল প্রেমচাঁদের কলম থেমেছে। অথচ, এই উপমহাদেশের যেসমস্ত সংকটের কথা তিনি বলতেন, আজও তার প্রত্যেকটি প্রকট হয়ে রয়েছে। তাই প্রেমচাঁদও দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুতে পারেন না। তীক্ষ্ন দৃষ্টি আর তীব্র বীক্ষার অনন্যসাধারণ পরশমণি সম্বল করে তিনি রাত জেগে আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নথিকরণের ব্রত নিয়ে। বাইরের পৃথিবীর সাথে অন্তরতরকে মেলাবার জন্য শিল্পীকে আজীবন ব্রতপালন করতে হয়। দুইয়ের মাঝে তফাৎ যত কমিয়ে ফেলা যায়, একজন শিল্পী তথা সাহিত্যিক ততই প্রগতিশীল হয়ে ওঠেন। তাহলে ‘প্রগতি’ বলতে কী বোঝায়? প্রেমচাঁদ বলেন, “যে পরিস্থিতিতেুও আমাদের ভিতর কর্তব্যপালনের প্রতিজ্ঞা জাগ্রত হয়, যা আমাদের সামাজিক অধঃপতনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, অন্তরঙ্গে ও বহিরঙ্গে যেসমস্ত কারণগুলো আমাদের পতনমুখী করেছে, সেই কারণসমূহকে নির্মূল করার অঙ্গীকারের নাম প্রগতি”। সেই আরাধ্য প্রগতির দেখা না পাওয়া পর্যন্ত প্রেমচাঁদ মেঘমানসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘দেশ’ হয়ে জেগে রয়েছেন।

লেখক: তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষক, বিশ্বভারতী

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুলাই নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের জ্বালা শুরু হয়েছে: ইলিয়াস হোসাইন Jul 01, 2025
img
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ চান ট্রাম্প: হোয়াইট হাউজ Jul 01, 2025
img
ভারতে রাসায়নিক কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত ৩৪ Jul 01, 2025
img
"১৬ জুলাই ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ ছিল, আমরা এটাই চাই" Jul 01, 2025
img
৫ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের হাজিরায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ Jul 01, 2025
img
জানি তোমাদের আশ্রয় দরকার নেই, তবুও আমরা আছি : আসিফ আকবর Jul 01, 2025
img
সামান্থার নতুন চমক, ফ্যাশন আইকন থেকে প্রযোজনায় নাম লেখালেন Jul 01, 2025
img
নাসির-তামিমার মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি ১৪ জুলাই Jul 01, 2025
img
তিন ভাষায় তিন চরিত্র, বহুরূপী অভিনয়ে আসছে দুলকার সালমান Jul 01, 2025
img
২০৪০ জন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হলো জুলাই শহীদ স্মৃতি বৃত্তি Jul 01, 2025
img
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির নতুন তথ্য দুদকের হাতে Jul 01, 2025
img
সংস্কারবিহীন নির্বাচন জামায়াত গ্রহণ করবে না: মুহাম্মদ তাহের Jul 01, 2025
img
আমি কখনও নিজের তারকাখ্যাতিকে গুরুত্ব দেইনি: আর মাধবন Jul 01, 2025
img
বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু Jul 01, 2025
img
টলিপাড়ায় ফের বিচ্ছেদ, ঘর ভাঙছে অভিনেত্রীর Jul 01, 2025
img
৪৮ তম বিসিএস পরীক্ষার তারিখ প্রকাশ Jul 01, 2025
img
আমরা যারা লড়াই চালিয়ে গিয়েছি এটা ছিলো আমাদের দেশরক্ষার ঈমানি দায়িত্ব: ইশরাক হোসেন Jul 01, 2025
img
হাতিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযান, আটক ৪ Jul 01, 2025
img
ওটিটিতে ২৫ জুলাই মুক্তি পাচ্ছে কাজলের নতুন থ্রিলার! Jul 01, 2025
img
আমরা এক থাকলে আমাদের সামনে কিছুই টিকতে পারবে না : ফারুকী Jul 01, 2025