হিটলারের পরমাণু বিজ্ঞানীদের ধরতে পরিচালিত হয় যে গোপন মিশন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় মিত্র শক্তির সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ছিল অ্যাডলফ হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর তথাকথিত ‘উন্ডারওয়াফেন’ বা ‘আশ্চর্য অস্ত্র’।  এই উন্ডারয়াফেন কি সে সম্পর্কে কারই কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

কেউ কেউ বলছিলেন ‘উন্ডারওয়াফেন’ এমন অস্ত্র যা দিয়ে ভূমিকম্প তৈরি করা যাবে (ভূমিকম্পের জেনারেটর), আবার কেউ বলছিলেন এটি ডেথ রে বা মৃত্যু রশ্মি তৈরি করবে। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়া অস্ত্র, রকেট এবং নতুন ভয়ানক কোনো গ্যাস প্রভৃতি নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।

সব থেকে যৌক্তিক ধারণাটি ছিল, জার্মানরা একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে জার্মানি পরমাণু গবেষণায় অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯৩৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক রি-অ্যাকটর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইউরেনিয়ামের মজুদ জোগাড় করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য কোয়ান্টাম পদার্থবিদ ওয়ার্নার কার্ল হেইসেনবার্গের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল একটি বিশেষ বৈজ্ঞানিক ইউনিট।

এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৩ সালে আমেরিকায় একটি গোপন স্পেশাল-অপস ইউনিট সংগঠিত হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল নাৎসি পারমাণবিক সংক্রান্ত তথ্য আবিষ্কার করা এবং তাদের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের কিডন্যাপ করা। কর্নেল বোরিস টি পাশের নেতৃত্বে বিজ্ঞানী ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর সদস্যের দ্বারা গঠিত এই বিশেষ ইউনিটটির নামকরণ করা হয় ‘দ্যা অ্যালসস মিশন’ এবং এর কোড নেম ছিল ‘লাইটেনিং এ’।

অপারেশন বিগ

১৯৪৫ সালের ২২ এপ্রিল মিত্রবাহিনী জার্মানী দখলের আগেই আমেরিকা ‘অপারেশন বিগ’ নামে জার্মানির অভ্যন্তরে একটি গোপন মিশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই গোপন মিশনের দায়িত্ব দেয়া হয় ‘লাইটেনিং এ’ ইউনিটকে।

মিত্রবাহিনী পৌঁছানোর আগেই এপ্রিলে পাশের একটি ছোট বাহিনী মাত্র দুটি সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান মাউন্টেড চারটি জিপ এবং কিছু জার্মান অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রু অঞ্চলে প্রবেশ করে। নাৎসি সরকারের এই ভঙ্গুর দশার মধ্যেও তাদেরকে তথাকথিত ‘ওয়্যারউলফ’ বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

তবে কিছুই তাদেরকে আটকাতে পারেনি, জার্মানির হাইগারলচের অদূরেই একটি গুহায় কর্নেল পাশ জার্মানির আবিষ্কৃত পারমাণবিক চুল্লিটি এবং একটি ল্যাব খুঁজে পান। পরের দিন আমেরিকানরা এটি খুলতে শুরু করে এবং পরে সাইটটি ধ্বংস করে দেয়।

এরপর লুকিয়ে থাকা জার্মান বিজ্ঞানীদের খোঁজার উদ্দেশ্যে তার দলকে ছোট কয়েকটি উপদলে বিভক্ত করেন কর্নেল পাশ । একটি ‘লাইটেনিং-এ’ ইউনিট টেইলফিনজেনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তারা অনেক কষ্টে ওয়্যারউলফের আক্রমণ থেকে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হয়। অপর দলটি বিসিংগেনের দিকে যায়, সেখানে স্থানীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করে তারা শহরটিকে দখল করে নেয়।

মানব বর্জ্য ঘেঁটে গোপন নথি উদ্ধার

২৪ শে এপ্রিল, পাশের দল জার্মান পারমাণবিক গবেষণা প্রচেষ্টার জন্য পরীক্ষাগারে রূপান্তর করা একটি টেক্সটাইল মিল এবং বেশ কয়েকটি ভবন আবিষ্কার করেন । সেখানে তারা ২৫ জন বিজ্ঞানীকে সমবেত করেন।

জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছিলেন যে, জার্মানদের পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র ধ্বংস করা হয়নি। সেগুলি একটি জলরোধী ড্রামের ভিতরে সিল করে সিসপুলে (গোপন খাল) ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

পাশ অধস্তনকারীদের কাছে দলিলগুলি পুনরুদ্ধার করার ঘৃণ্য কাজটি অর্পণ করেছিলেন। তারা মানব বর্জ্য নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটির পরে ড্রামটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।

এছাড়াও তিনি কাছের একটি জমিতে সমাহিত অবস্থায় নাজিদের ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার এবং হেভি ওয়াটার (এক ধরণের পানি যা অধিক পরিমাণে হাইড্রোজেন ধারণ করতে সক্ষম) পেয়েছিলেন। এমনকি তারা হেইসেনবার্গের অফিসের অবস্থানও শনাক্ত করেছিলেন, তবে সেখানে থেকে ততক্ষণে বিজ্ঞানী পালিয়ে গিয়েছিলেন।

হেইসেনবার্গের অনুসন্ধান

অপারেশন বিগ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাশ হেইসেনবার্গকে ধরতে চাইছিলেন। মিত্র শক্তির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, হিটলার সব শেষে ওয়ান্ডারওফেন আক্রমণ চালাবেন। 

গোপন তথ্যের উপর ভিত্তি করে হেইসেনবার্গকে ধরতে পাশ তার দলকে নিয়ে এ সময় বেভেরিয়ার অ্যালপসের দিকে এগিয়ে যান। ওয়্যারউলফের সদস্যরা সেখানে পৌঁছানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করে দিলে তিনি তার ১৯ সদস্যকে নিয়ে পায়ে হেঁটে পর্বতের চূড়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।

তারা যখন ওয়ালচেনের আলপাইন হ্রদের নিকটবর্তী উরফেল্ড শহরে পৌঁছালেন। জার্মানরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছিল। প্রায় ৭০০ এসএস সৈন্য তার ছোট্ট বাহিনীটির কাছে আত্মসমর্পণ করে।  

কিছুটা চতুরতার মাধ্যমে পাশ জার্মানদের বিশ্বাস করিয়েছিল যে, তার বাহিনী আরও অনেক বড়। তবে আদতে তিনি আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের সম্পর্কে একটুও আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সেখানে হেইসেনবার্গকে খুঁজতে গিয়েছিলেন।

স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে তাদের খোঁজ চলতে থাকে এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালের ২ মে পাশ সেই জার্মান বিজ্ঞানী এবং তার পরিবারকে পর্বতের একটি কেবিনে খুঁজে পান। এর দুদিন আগে হিটলার তার বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেছিলেন।

পরবর্তীতে আটক এই জার্মান বিজ্ঞানীদের ইংল্যান্ডের ফার্ম হল নামে একটি সেফ হাউজে নিয়ে আসা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা নিজেদেরকে প্রকাশ্যে নাজি-বিরোধী বলে দাবি করেন এবং হিটলার যাতে পারমানবিক বোমা না পায় সেজন্য তারা বোমা আবিষ্কারের অগ্রগতি হ্রাস করতে ‘প্যাসিভ এগ্রেসিভ’ পথে কাজ করছিলেন বলেও দাবি করেন।

আমেরিকা হিরোশিমাতে একটি পরমাণু বোমা সফলভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জেনে জার্মান বিজ্ঞানীরা অবাক হয়েছিলেন। তারা সত্যিই নাজি বিরোধী ছিলেন কিনা তা ধাঁধার বিষয় হলেও, তারা পরমাণু বোমা তৈরির ধারে কাছেও ছিলেন না সে বিষয়ে আমেরিকান গোয়েন্দেরা নিশ্চিত ছিলেন। তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি.কম।

 

টাইমস/এনজে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আ.লীগের ব্যবসাগুলো কারা চালায় আমরা জানি : হাসনাত আবদুল্লাহ Jul 05, 2025
img
টানা ৯ দিন পানি ছাড়া কিছু খাননি অভিনেত্রী নার্গিস! Jul 05, 2025
img
নিজের লড়াইয়ের গল্প শোনালেন রাশ্মিকা Jul 05, 2025
img
সিলেটে দুই বাসের সংঘর্ষে প্রাণ গেল ১ জনের, আহত ৩০ Jul 05, 2025
img
সুশান্তের পর এবার টার্গেট কার্তিক! Jul 05, 2025
img
১৪ আগস্ট বড়পর্দায় আসছে ‘ওয়ার ২’ বনাম ‘কুলি’! Jul 05, 2025
img
শান্তর বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ইতিহাস গড়লেন সূর্যবংশী Jul 05, 2025
img
গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তারেক রহমান: খোরশেদ Jul 05, 2025
img
টেন্ডার জটিলতায় আটকে গেল প্রাথমিকের মিড ডে মিল Jul 05, 2025
img
নতুন সিনেমা নয়, অভিনেত্রী কাজলের রেটিং নিয়েই চলছে বিতর্ক! Jul 05, 2025
img
গ্ল্যামার নয়, সততা দিয়ে জয় করেছেন সাই পল্লবী Jul 05, 2025
img
বিজয়ের ফিরিয়ে দেওয়া চরিত্রে ধানুশের বাজিমাত Jul 05, 2025
img
তুর্কমেনিস্তানকে ৭ গোলে পরাজিত করল বাংলাদেশ Jul 05, 2025
img
অভিনেতা বাপ্পীর সঙ্গে ছবি প্রকাশ, কী ইঙ্গিত দিলেন মিষ্টি জান্নাত? Jul 05, 2025
img
অনার্স পরীক্ষায় নকল করলে চার বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা Jul 05, 2025
img
পুরোনো খেলায় নতুন প্লেয়ার নয়, খেলার নিয়ম বদলাতে এসেছি: নাহিদ ইসলাম Jul 05, 2025
img
ভোলায় কোস্টগার্ডের অভিযানে ৭ কোটি টাকার অবৈধ পণ্য জব্দ Jul 05, 2025
img
১৩ গোলের উৎসবে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দাপুটে জয় Jul 05, 2025
img
আওয়ামী নেতাকর্মীরা স্থানীয় সরকারকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল : প্রিন্স Jul 05, 2025
img
বার্তা ভুল বোঝায় ফ্লাইটে আতঙ্ক, জরুরি অবতরণ Jul 05, 2025