বন্ধু রাষ্ট্র ভারত! বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে দেশটি পাশে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের কূটনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কারে ভারতের প্রভাব চোখে পড়ার মতো। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্যই বেশি চলে। বলা যায়, ভারতের বৃহৎ একটি বাজার এই বাংলাদেশ।
কিন্তু ভারতীয় নানা কর্মকান্ডে বাংলাদেশীরা দিনদিন প্রতিবেশী দেশটির ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এই যে পেঁয়াজ নিয়ে ভারত যে তালবাহানা শুরু করেছে, তা কি বন্ধুসুলভ? হুট করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই তারা বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও শুধু বাংলাদেশই নয়, সব দেশেই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে মোদি সরকার।
ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিন কেজি প্রতি গড়ে ৩০ টাকা হারে দাম বাড়ছে পেঁয়াজের। গত বছরও ভারত পেঁয়াজ বন্ধ করে বাংলাদেশে এই
মশলাটির দাম কেজি প্রতি ৩০০ টাকায় তুলে দিয়েছিল। এবার বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি রেখেছিল। ভারত রপ্তানি বন্ধ করতে পারে ভেবে, বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বিকল্প দেশের সঙ্গে পেঁয়াজ ক্রয়ের প্রস্তুতি রেখেছিল। কিন্তু ভারত এবার কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারতের এই আচরণ বাণিজ্যিক অগ্রাধিকার ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ধারণাকে কলুষিত করেছে। তিস্তাচুক্তি, মাতামুহুরি পানিবন্টন চুক্তিসহ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যূতেই ভারত ছাড় দেয়নি। বরং বাংলাদেশ থেকে ফ্রি ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছে দেশটি। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের সামনে একটা মুলো ঝুলিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে বেশ পটু ভারত। তারা বারবার এটাই করে আসছে। ভারতে সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু তাদের বাণিজ্য, কূটনীতি ও জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসে না।
যাইহোক পেঁয়াজ প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের সরকারি হিসাব বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৩ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। বাকি ১৯ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ দেশের বাজারে থাকে। তবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত হচ্ছে ১৯ লাখ মেট্রিক টন। বাকি ১১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। যার বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে।
আর সুযোগ পেয়ে এই পেঁয়াজ নিয়েই বারবার নোংরা বাণিজ্য খেলা করে চলেছে ভারত। ন্যূনতম বাণিজ্যিক শিষ্ঠাচার জানা থাকলে ভারত এ আচরণ করতে পারতো না। ভারতের ভাবসাব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে পেঁয়াজ অনুদান হিসেবে নিয়ে থাকে। কিন্তু এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। গাটের টাকা খরচ করে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের আচরণে সেটা বুঝার উপায় নেই। তা না হলে, তারা হুটহাট বলা নেই, কওয়া নেই, রপ্তানি বন্ধ করে দেবে?
এদিকে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর গত কয়েকদিনে বিশ্ব বাজারেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। একদিনের ব্যবধানেই আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম টন প্রতি ৫০ থেকে ১০০ ডলার বেড়ে গেছে। তবে ভারতের বাইরে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও ভারতের ভিতরে পেঁয়াজের দাম তলানিতে।
গত ক’দিনে ভারতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১৬ থেকে ১৮ রুপি। আর এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশটির পেঁয়াজ চাষিরা। তারা ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। ভারতের ইন্দোর, মহারাষ্ট্র, বিহার, কেরালায় পেঁয়াজ চাষীরা ক্ষুব্ধ। তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
তবে হঠাৎ কেন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে বিবিসিসহ বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতের রাজনীতিতে পেঁয়াজের একটা দারুণ প্রভাব আছে। এই দ্রব্যটির দামের সঙ্গে ভারতীয়দের ভোটের পারদ উঠানামা করে।
গত বছর পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের ভরাডুবি হয়েছে। সেই ধারণা থেকেই এবার আগে ভাগেই পেঁয়াজের মাথায় জল ঢালতে শুরু করেছেন মোদি। যে কারণে পেঁয়াজ রপ্তানি না করে দেশের পেঁয়াজের বাজারের আগুন নেভাতে মোদি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি এর আগেও নাকি ভারতে পেঁয়াজের দাম নাগালে না থাকার কারণে কেন্দ্রীয় সরকারও পতন হয়ে গেছে।
কাজেই মোদি সরকার পেঁয়াজের ঝাঁঝ ঘরের ভেতরেই ধরে রাখতে চাইবেন। তাতে দোষেরও কিছু নেই। কিন্তু হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়ার যে কুফল তা তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে। আর সেই কুফলের মুখোমুখি এখন ভারত। দেশটিতে পেঁয়াজের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বিরোধী ক্ষোভ এ কয়দিনেই তীব্র হয়ে উঠেছে। ক্ষোভে ফুঁসছেন কৃষক।
কিন্ত কথা হলো, ভারতে কেন আন্দোলন? ভারতের কৃষকরা কেন পেঁয়াজ আটকে গো ধরে বসে আছেন? ভারতের ডজন খানেক রাজ্যের খুচরা ও পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের আমদানি নেই। কারণ কৃষকরা পেঁয়াজ বাজারে তুলছেন না। লোকসানের বোঝা মাথায় নিতে চান না ভারতীয় কৃষকরা।
যে কারণে ভারতে দাম না বাড়লেও পেঁয়াজ যে হরহামেশা পাওয়া যাচ্ছে তা বলা যাবে না। বরং পেঁয়াজ নিয়ে ভারত সরকার এখন অহীনুকুল সংকটে পড়েছে। ঘর সামলাতে পড়শীকে বঞ্চিত করে ভারত এখন ঘরের আগুনেই জ্বলে পুড়ে মরছে।
ভারত যে উভয় সংকটে পড়েছে, তা তারা সহসায় কাটিয়ে উঠতে না পারলেও বাংলাদেশ ঠিকই পেঁয়াজের বিকল্প বাজার পেয়ে গেছে। মায়ানমার, পাকিস্তান, চীন, তুরস্ত ও মিশর থেকে পেঁয়াজ ক্রয়ের প্রস্তুতি চূড়ান্ত। এখন শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা। তবে এই সময়টাতে দেশের ভোক্তা সাধারণকে একটু ধৈর্য্যশীল হতে হবে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে কোনো সমাধান হবে না।
টাইমস/এসএন