মানব সমাজে প্রচলিত জঘন্যতম অপরাধের একটি হচ্ছে ধর্ষণ। আদিকাল হতেই সমাজের জন্য যা মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বিশ্বের প্রায় সকল সমাজেই এর অস্তিত্ব রয়েছে এবং ইতিহাসের সকল পরতেই ধর্ষণের মত বর্বর ঘটনার নজির পাওয়া যায়।
ফলে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কেন মানুষ বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পুরুষেরা এহেন অপকর্মটি করে থাকেন? আপাত দৃষ্টিতে সরল এই প্রশ্নটির উত্তর আসলে খুব একটা সহজ নয়। কারণ ধর্ষণের মত অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পেছনের কারণগুলি স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমেরিকান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. স্যামুয়েল ডি স্মিথম্যান এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে নাম না প্রকাশের শর্তে ৫০ জন স্বঘোষিত ধর্ষক পুরুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। এদের পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব এবং মানসিকতা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তবে অবাক হওয়ার মতো একটি বিষয় হলো, ধর্ষণ যে একটি ফৌজদারি অপরাধ সে বিষয়ে এদের কেউ খুব একটা সচেতন ছিলেন না। অর্থাৎ বহু অমিল সত্ত্বেও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন।
এভাবেই বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে ধর্ষণকারী বা ধর্ষকের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। খুব মোটা দাগে বলতে গেলে সেগুলো হলো- সহানুভূতির অভাব, নার্সিসিজম বা আত্মরতি, মহিলাদের প্রতি বৈরি মনোভাব প্রভৃতি।
বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র
ধর্ষণের অন্যতম একটি প্রধান কারণ পুরুষতন্ত্র বা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি স্টেটের সাউথ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক শেরি হামবির মতে, “যৌন তৃপ্তি বা যৌনতা সম্পর্কে আগ্রহের সাথে যৌন নিপীড়ন সেই অর্থে সম্পর্কিত নয়, এর সাথে প্রভাবশালী পুরুষদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।” অর্থাৎ ধর্ষণের সাথে ব্যক্তির ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হামবি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রচার করে। তিনি বলেন, “ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন নিপীড়নের সাথে সম্পর্কিত অধিকাংশ অপরাধীই তরুণ। অনেকক্ষেত্রে পুরুষ সমবয়সীদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হলো উচ্চতর যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করা। অন্যদিকে যৌনতায় সক্রিয় না থাকা লজ্জাজনক হিসেবে বিবেচিত হয়।”
তার মতে, সমবয়সীদের কাছ থেকে এই ধরণের মানসিক চাপ পুরুষদেরকে যৌন অপরাধী হিসাবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। “সহকর্মী বা বন্ধুরা জেনে যাবে যে তাদের কোন যৌন অভিজ্ঞতা নেই, অনেকেই এই ধরণের আতঙ্কে ভোগেন” বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এছাড়াও সংস্কৃতিতে এমন কিছু পুরুষতান্ত্রিক উপাদান রয়েছে যার দ্বারা পুরুষদের মধ্যে এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসের সৃষ্টি হয় যে পুরুষ হিসাবে তাদের উচিত নারীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে অনেক সময় ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে যেহেতু খুব বেশি যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতা না থাকাটা লজ্জার এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন রয়েছে, তাই যৌন অভিজ্ঞতা লাভের জন্যও অনেকে ধর্ষণের মত ঘৃণিত অপকর্ম করে থাকেন।
ধর্ষণ কি এক ধরণের যৌন আকাঙ্ক্ষা নাকি সহিংসতা?
প্রথমে এই বিষয়ে জেনে রাখা দরকার যে ধর্ষণ কোন আচরণমূলক বা মানসিক ব্যাধি নয়, এটি একটি অপরাধ। কোন কোন সময় দুই একজন ধর্ষকের মানসিক ব্যাধি থাকতে পারে, তবে এমন কোন ব্যাধি নেই যা মানুষকে ধর্ষণ করতে প্ররোচিত করে।
তবে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ধর্ষণের সাথে যৌনতার সম্পর্ক রয়েছে। যেমন বিবর্তন বিষয়ক জীববিজ্ঞানী র্যান্ডি থর্নহিল এবং বিবর্তনবাদী নৃবিজ্ঞানী ক্রেগ পামার বিশ্বাস করেন, ধর্ষণের পিছনে প্রাথমিক উদ্দেশ্যটি আসলে যৌনতা। অবশ্য অধিকাংশ গবেষকই এই মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। সাইন্স জার্নাল ‘নেচার’ এ তাদের এই মতবাদ তীব্র সমালোচিত হয়েছে। সমালোচনায় বলা হয়েছে এই দুজনের ব্যবহার করা উদ্ধৃতিগুলো বিভ্রান্তিমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট বা সমানভাবে বিকল্প ব্যাখ্যা সমর্থন করে।
প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং নারীবাদী কর্মীর মত হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের সাথে ক্ষমতা এবং সহিংসতার বিষয়গুলো সম্পর্কযুক্ত। তাদের মতে, ধর্ষণ কোন কামনা-বাসনার নয়, এটি নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যবাদের তাগিদ এবং নারীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের দ্বারা পরিচালিত হয়।
নারীর প্রতি বৈরিতার মনোভাব
ধর্ষকদের সাধারণ একটি মানসিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা প্রায়শই মহিলাদেরকে পুরুষের যৌন চাহিদা পূরণের জন্য উপস্থিত যৌন সামগ্রী হিসাবে বিবেচনা করেন। এছাড়াও তারা অন্যান্য ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সময় একজন ধর্ষক বিশ্বাস করেন যে, কোন মহিলা যদি ‘না’ বলেন, তবে তার সত্যিকার অর্থ ‘হ্যাঁ’, এবং মহিলাটি তার সাথে খেলছেন বা তাকে চ্যালেঞ্জ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েইন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মনোবিজ্ঞানী আন্তোনিয়া অ্যাবে বিভিন্ন ধর্ষকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “একাধিকবার যৌন হেনস্তাকারী পুরুষদের বিশ্বাস হলো- বেশিরভাগ মহিলারা প্রথমে ‘না’ বলে থাকেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই তিনি না করছেন কিনা তা পুরুষকে বুঝে নিতে হয়।”
অ্যাবির উদ্ধৃতিতে একজন অপরাধীর মন্তব্য, “আমি মনে করি, আমি যা পেয়েছি (যৌন অভিজ্ঞতা) তা আমার প্রাপ্ত ছিল। আমাকে যৌন উত্তেজনা প্রদানের জন্য তার উপর প্রতিশোধ নিয়েছি।” এই ব্যক্তিটি তার ধর্ষণের অভিজ্ঞতাকে “শক্তিশালী” এবং “খুব উত্তেজনাপূর্ণ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
আমাদের দেশেও কিন্তু এধরণের মন্তব্য হরহামেশা শোনা যায়। ধর্ষিতা নারীর পোশাক নিয়ে সমালোচনা করা হয়, ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষককে উত্তেজিত করার জন্য দোষারোপ করা হয়। এ ধরণের মানসিকতা একধরণে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ
শেরি হামবির মতে, কিছু কিছু সংস্কৃতিতে পুরুষতন্ত্র এবং আধিপত্যবাদ এক ধরণের “অমানবিকীকরণ” এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় যেখানে নারীদের নিকৃষ্ট মানের প্রাণী হিসাবে দেখা হয়। এটি মহিলাদেরকে আগ্রাসনের সহজ টার্গেটে পরিণত করে।
হামবির মতে, এই জাতীয় সংস্কৃতি পুরুষদের জন্য, “তাদের সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণের একটি অংশ, যা তাদেরকে তাদের আবেগের সংস্পর্শ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তারা নিজের অনুভূতিগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে তা জানে না এবং আরও ভয়ানক বিষয় হলো তারা অন্যের অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন নয় বা সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেই করে না।”
গবেষকগণ নারসিসিস্ট এবং একাধিকবার ধর্ষণকারীদের মধ্যে দৃঢ় যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছেন। ধর্ষক এবং নারসিসিস্টদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মিল হলো- অপরকে মানুষ বলে মনে না করার প্রবণতা। এধরণের প্রবণতা ধর্ষকের মধ্যেও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
ধর্ষকের ধরণ
ধর্ষণের কারণে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি ধর্ষকেরও একাধিক ধরণ বা প্রকার ভেদ রয়েছে। যেমন ‘সুবিধাবাদী ধর্ষণকারী’। এরা নিজের যৌন তৃপ্তির জন্য কোন সুযোগকে ব্যবহার করে থাকে। যেমন অ্যালকোহল বা কোন ড্রাগের প্রভাবে কেউ নিজের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারালে তারা সে সুযোগকে কাজে লাগায়।
এক প্রকার ধর্ষক রয়েছে যারা হতাশাবাদী ধর্ষণকারী, এরা ভুক্তভোগীকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে নিজের বাসনা চরিতার্থ করে। আবার কোন কোন ধর্ষক ক্রোধ এবং আগ্রাসনের বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে ধর্ষণ করে থাকে। এই ধরণের ধর্ষক বিশ্বাস করে যে মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের অধিকার তার রয়েছে, কারণ সে অতীতে নারীদের দ্বারা আহত, প্রত্যাখ্যাত বা অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছিল।
অন্যদিকে সব ধরণের ধর্ষকদের মধ্যে একটি অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য হলো এরা প্রায়শই ধর্ষণ করার কথা অস্বীকার করে এবং সেগুলো বৈধতা-দানের চেষ্টা করে। অন্য দিকে যে সব পুরুষেরা ধর্ষণের কথা স্বীকার করে তারা প্রায়শই তাদের কৃতকর্মের জন্য বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করাতে চেষ্টা করে।
তবে ধর্ষণের পেছনে কারণ যাইহোক না কেন, যৌন নিপীড়ন একটি জঘন্যতম হিংসাত্মক কাজ এবং অমার্জনীয় অপরাধ। এর শেকড় আমাদের সমাজ ও মানসিকতার অনেক গভীরে প্রোথিত আছে। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের চিন্তা-চেতনার বিকাশ প্রয়োজন, প্রয়োজন পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নারী-পুরুষের সম্মানজনক সহাবস্থান।
তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভ্যালে ইংরেজি।