রবার্ট পিল: আধুনিক পুলিশের জনক

স্যার রবার্ট পিল। একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং সাবেক রাষ্ট্রনেতা। ১৮৩৪-৩৫ এবং ১৮৪১-৪৬ দুই মেয়াদে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া ১৮২২-৩০ মেয়াদে তিনি দুইবার ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের আধুনিক কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। তাকে বলা হয় ‘আধুনিক পুলিশের জনক’।

রবার্ট পিল ১৭৮৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন হ্যারো এবং অক্সফোর্ডে। তার বাবা ছিলেন একজন ধনাঢ্য শিল্পপতি। বাবার টাকার প্রভাবে ১৮০৯ সালে তিনি ব্রিটেনের সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের সদস্য হন।

১৮১০ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ এবং উপনিবেশ বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর দুই বছর পর তাকে আয়ারল্যান্ডের মুখ্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে তিনি অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনা করেন, যা তার পদন্নোতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

১৮১৯ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের মুদ্রা কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এসময় তিনি ব্রিটেনের মুদ্রানীতি সংস্কারে ভূমিকা রাখেন। ধীরে ধীরে তিনি কনজার্ভেটিভ পার্টির একজন উদীয়মান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৮২২ সালে ব্রিটেনের সেক্রেটারি অব স্টেট তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান রবার্ট পিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ব্রিটেনের বিভিন্ন অপরাধ আইন প্রণয়ন ও সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এসময় শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে ইংল্যান্ডে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে তিনি একটি নিয়মতান্ত্রিক পুলিশবাহিনীর অভাব অনুভব করেন।

তাই ১৮২৯ সালে মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে তিনি লন্ডন মেট্রোপুলিশ গঠন করেন। এসময় পুলিশ বাহিনীর উন্নতির জন্য তিনি বেশ কিছু ধারণার প্রবর্তন করেন যা ‘Peelian Pronciples’ নামে পরিচিত।

১৮২৭ সালে জর্জ ক্যানিং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলে রোমান-ক্যাথলিক বন্দিমুক্তি বিষয়কে কেন্দ্র করে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ১৮২৮ সালে আর্থার ওয়েলেসলি প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ক্যাথোলিক অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে ১৮২৩ সালে আয়ারল্যান্ড স্বাধীনতা দাবি করেছিল। ওয়েলেসলি প্রধানমন্ত্রী হবার পর তার সঙ্গে মতবিরোধ নিয়ে জর্জ ক্যানিং এর বেশ কয়েকজন অনুসারী পদত্যাগ করলে ব্রিটিশ সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ১৮২৯-৩০ সময়ে আবার ক্যাথোলিক সংকট দেখা দেয় এবং আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠার আশংকা দেখা দেয়।

এসময় রবার্ট পিল ক্যাথোলিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ওয়েলেসলিকে আহবান জানান, অন্যথায় পদত্যাগের হুমকি দেন। পরে এর সমাধান করার আশ্বাস দিয়ে রবার্ট পিলকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন ওয়েলেসলি।

১৮৩০ সালে ওয়েলেসলির সরকারের পতন হলে রবার্ট পিল বিরোধী দলে চলে যান। অবশ্য পরবর্তীতে ১৮৩৪ সালে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হবার পরপরই ডিসেম্বরে তিনি তামওয়ার্থ ম্যানিফেস্ট্যু ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার নীতির উপর ভিত্তি করেই ব্রিটেনের বর্তমান কনজার্ভেটিভ পার্টি প্রতিষ্ঠিত।

তবে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র চারমাসের মাথায় রবার্ট পিলের সরকারের পতন ঘটে। ফলে ১৮৩৫-৪১ মেয়াদে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। পরে ১৮৪১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ব্রিটেনের অর্থনীতি ও বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে তিনি কর কর্তন করেন। এছাড়া মুক্তবাণিজ্য এবং আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন ও নীতি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১৮৪৩ সালে এক স্কটিশ দুষ্কৃতিকারী তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবশেষে আয়ারল্যান্ড সংকটকে কেন্দ্র করে মেয়াদের শেষ দিকে ১৮৪৬ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।

১৮৫০ সালের ২ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান আধুনিক পুলিশের জনক রবার্ট পিল।

ঐতিহাসিক বয়েড হিল্টন তার সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন একজন মহান কনজার্ভেটিভ দেশপ্রেমিক, প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, বুদ্ধিমান ও চৌকস একজন নেতা।

জীবনী লেখক নরম্যান গাশ বলেন, রবার্ট পিল দলের চেয়ে প্রথমে দেশকে ও দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক, অত্যন্ত পরিশ্রমী, দূরদর্শী ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী একজন ব্যক্তিত্ব।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ