ভলতেয়ার: বিখ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক

ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে, যিনি ছদ্মনাম ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত। ফরাসি আলোকময় যুগের একজন লেখক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। খ্রিস্টান ধর্মের (বিশেষ করে রোমান ক্যাথোলিক চার্চের) বিভিন্ন বিষয়ের কঠোর সমালোচনা করে তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দার্শনিক মতবাদ, সাহিত্যিক কাজের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখার পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন

১৬৯৪ সালের ২১ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ভলতেয়ারের জন্ম। চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে তার পরিবার রাজনৈতিকভাবে অনেক সুবিধা পেয়েছিল।

দুর্ভাগ্যক্রমে তার বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখনই তার মা মারা যান। এই ঘটনাটি বাবা ও বড় ভাই-বোনদের প্রতি তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। পরিণামে বিদ্রোহী এই বালকটি আশ্রয় পায় ধর্মপিতা অ্যাবের কাছে, যিনি নিজেও একজন মুক্ত-চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত।

লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্বপ্ন ছিল একজন নাট্যকার হবেন, কিন্তু তার ধর্মপিতা বিরোধিতা করেন এবং একজন সরকারী কর্মকর্তা হতে চাপ দেন। তাই ধর্মপিতার ইচ্ছে অনুযায়ী প্যারিসে নোটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু, তিনি তার অধিকাংশ সময়ই বিদ্রূপাত্মক কবিতা লিখে ব্যয় করেছেন। পরে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সচিব হিসেবে নেদারল্যান্ডে চলে যান।

প্যারিসে ফিরে আসার পর ১৭১৭ সালে তিনি ফরাসি সরকারকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক লেখা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ডিউক অব অর্লিন্সকে নিয়ে উপহাস করেছেন। ফলস্বরূপ তিনি কেবল প্যারি থেকেই বিতাড়িত হননি, সেইসঙ্গে তাকে ১১ মাস জেল খাটতে হয়েছে।

অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে পরের বার ১৭২৬ সালে বিনা বিচারে তাকে ইংল্যান্ডে নির্বাসন দেয়া হয়। সেখানে তিন বছর নির্বাসনে থাকাকালে তিনি জন লোক, নিউটন ও ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করেন।

প্যারিসে ফিরে আসার পর ১৭৩৪ সালে তিনি ‘ফিলোসফিক্যাল লেটার্স অন ইংলিশ’ নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধগুলোতে তিনি ব্রিটিশ সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেন, যা ছিল ফরাসি সমাজ ব্যবস্থার বিপরীত। ফলে তার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং জনরোষানলে পড়ে আবারও তিনি শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

১৭৩৪ থেকে ১৭৪৯ সময়ে নির্বাসনে থাকাকালে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়ন করেন। একই সঙ্গে তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন ধরণের দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছেন।

১৭৪৯ সালে তিনি পটসড্যাম চলে যান। সেখানে তিনি বার্লিন অ্যাকাডেমি অব সাইন্সের সভাপতিকে আক্রমণ করে লেখা প্রকাশ করেন। ফলে আবারও তিনি জনরোষানলে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে তিনি সেই শহর ছেড়ে চলে যান। এদিকে ফ্রান্সের শাসক পঞ্চদশ লুই তাকে প্যারিসে নিষিদ্ধ করে দেন। এমতাবস্থায় তিনি এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে থাকেন এবং একপর্যায়ে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নেন।

বিভিন্ন সময়ে নির্বাসনে থাকাকালে তিনি প্রায় ২১ হাজার বই সংগ্রহ করেছেন এবং অধ্যয়ন করেছেন। অতঃপর তিনি রাষ্ট্র থেকে চার্চকে পৃথক রাখার জন্য আহবান জানান। অর্থাৎ তিনি ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার পক্ষে ছিলেন।

নির্ভুলভাবে বলতে গেলে তাকে একজন দার্শনিক বলা যায় না। তবে তিনি তার ব্যতিক্রমধর্মী লেখনীর মাধ্যমে নতুন ধারণা ও চিন্তাসমূহকে ফলপ্রসূভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘CANDIDE’ (১৭৫৯) গ্রন্থে গটফ্রিড উইলহ্যাম লিবনিজ এর অতি আশাবাদী দর্শনের স্পষ্ট সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে ব্লেইস প্যাসক্যাল কর্তৃক মানব অমঙ্গলতা নিয়ে অতি নৈরাশ্যবাদী দর্শনেরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।

একজন দার্শনিক হিসেবে ১৭৬৪ সালে তিনি বিখ্যাত ‘Philosophical Dictionary’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ১৭৫১-১৭৭২ সালে লেখা তার প্রবন্ধগুলো তিনি ‘Encyclopedia’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। এসব লেখায় তিনি অত্যন্ত খোলামেলাভাবে ফরাসি সমাজ, ধর্ম ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করেছেন।

ইতিহাসে ভলতেয়ারের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কেননা কিভাবে ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে, তার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

তিনি খ্রিস্টান, ইসলামসহ প্রায় সব ধর্মেরই সমালোচনা করেছিলেন। তাই অনেকের কাছেই তিনি একজন নাস্তিক হিসেবে পরিচিত। মূলত তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন একেশ্বরবাদী। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে যারা একেশ্বরবাদ নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের অন্যতম একজন ছিলেন ভলতেয়ার।

তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিচারের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ‘Treatise on Toleration’ (১৭৬৩) গ্রন্থে তিনি সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, সব মানুষেরই ঈশ্বর একজন। সুতরাং ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্য বিভেদ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা উচিত নয়।

তার কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বলতার সমালোচনা করেছেন। বরং একটি সচেতন, দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তিনি। তার মতে, জনগণকে শিক্ষিত করলে কেবল জনগণেরই উপকার হবে তা নয়, রাজার জন্যও এটা প্রয়োজন। এভাবেই তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে অভিজাত বর্গের সমালোচনা করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন।

২৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ১৭৭৮ সালে তিনি তার প্রিয় জন্মভূমি প্যারিসে ফিরে আসেন। এক সময় যাকে বার বার প্যারিসবাসী তাড়িয়ে দিয়েছিল, আজ তারা তাকে বুকে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন। ওই সময় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে দেখা হলে তিনি ভলতেয়ারকে একজন মুক্ত স্থপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

অবশেষে ১৭৭৮ সালের ৩০ মে এই মহান দার্শনিক মারা যান।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক, যার অসাধারণ লেখনী শক্তি তার সময়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় তুলে দিত। এমনও হয়েছে, সেই ঝড়ের আঘাতে কখনো কখনো অনেক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত দার্শনিক মতবাদ কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভীত নড়ে যেত। তার অধিকাংশ কর্মই ছিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনাকে কেন্দ্র করে। ফলস্বরূপ তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে, এমনকি নির্বাসনেও যেতে হয়েছে।

তার লেখনি সাধারণ মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করত যে, কখনো কখনো শহরের পর শহর লোকজন উত্তপ্ত হয়ে যেত এবং তার রচিত গ্রন্থগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিত। সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করার সুবাদে তার শত্রুর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি সরকারের অকার্যকারিতা, সাধারণ মানুষের মূর্খতা, চার্চের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং দুর্নীতিবাজ ও পরজীবী স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন।

তাই আঠারো শতকের ওই সময়ে রোমান ক্যাথোলিক চার্চ, ফরাসি সরকার, এমনকি সাধারণ মানুষেরও কাছে তিনি শত্রুতে পরিণত হয়ে পড়েন। এতদসত্ত্বেও তিনি ছিলেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক অন্যতম অগ্রসেনানী। যিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক, ইতিহাসসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই কাজ করেছেন। যেখানে কেবল চিঠির সংখ্যাই ছিল ২১ হাজার এবং বই-পুস্তকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজারেরও বেশি।

পুরো একটি জীবন বিতর্কে জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও, আজ তাকে ইতিহাসের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক এবং দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভলতেয়ারের কিছু বিখ্যাত উক্তি-

“পড় এবং নাচ কর, এই দুটি কর্ম কখনো বিশ্বের কোনো ক্ষতি করবে না।”

“জবাব দিয়ে নয়, একজন মানুষকে বিচার কর তার প্রশ্ন দিয়ে।”

“জীবন হচ্ছে একটি ডুবন্ত জাহাজ, তাই বলে নৌকায় থাকার সময় গান গাইতে ভুলে যাওয়া উচিত নয়।”

“যদি ঈশ্বর নাই বা থাকেন, আমাদের কর্তব্য হবে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করা।”

 

টাইমস/ইএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

রাশমিকার নতুন জীবনের শুরু, এবার মা হওয়ার ইচ্ছা Oct 29, 2025
অবৈধ মোবাইল নিয়ন্ত্রণে নতুন ধাপ: এনইআইআর কার্যক্রম শুরু Oct 29, 2025
img
নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেবে এনসিপি Oct 29, 2025
নসিপি কি সরকারি প্রতিষ্ঠান? ব্যাকডেট চাকরি প্রত্যাশিদের ডিসি মাসুদ Oct 29, 2025
বিচারক মহোদয়ের কাছে যে প্রশ্ন রাখলেন নুরুল হক নুর Oct 29, 2025
কেন একই দিনে গণভোট চায় বিএনপি? জানালেন সালাহউদ্দিন Oct 29, 2025
img
অবসরের পরে নিজের মূল্যায়ন করবেন দেব! Oct 29, 2025
রাজধানীতে ইবতেদায়ী শিক্ষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ, আহত বেশ কয়েকজন Oct 29, 2025
ফ্রিতে কুরআন পেয়ে আনন্দিত শিক্ষার্থীরা! Oct 29, 2025
img
যমজ সন্তানের বাবা হওয়ায় দেরিতে দলের সঙ্গে যোগ দেবেন ক্যাবরেরা Oct 29, 2025
img
নভেম্বরকে টার্গেট করেছে দেশি-বিদেশি চক্র, সতর্ক না হলে সর্বনাশ: রনি Oct 29, 2025
'উনি শান্তিতে নোবেল পাইছে, ওনার দেশের শিক্ষকরা কেন রাজপথে ?' Oct 29, 2025
প্রেসক্লাবের সামনে ইবতেদায়ী শিক্ষকের আহাজারি Oct 29, 2025
img

রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার

ক্ষমা চাইতে রাজি নন শেখ হাসিনা থাকতে চান ভারতেই Oct 29, 2025
img
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন সহজবোধ্য করে উন্মুক্ত করুন: প্রধান উপদেষ্টা Oct 29, 2025
img
অক্টোবরের ২৮ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৩৪ কোটি ডলার Oct 29, 2025
img
দুদকের সংশোধন অধ্যাদেশ অনুমোদনে টিআইবির উদ্বেগ Oct 29, 2025
img
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি : রেজাউল করীম Oct 29, 2025
img
নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ি এলাকায় ডিসি-এসপিদের পদায়ন নয় : প্রেসসচিব Oct 29, 2025
img
বিশ্ব ব্যাংকে সালিশি মামলা করেছেন এস আলম Oct 29, 2025