দাম্ভিকতা থেকেই তৈরি কর্ণফুলী টানেল: উপদেষ্টা ফাওজুল

সড়ক পরিবহণ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়াই রাজনৈতিক দাম্ভিকতা থেকেই তৈরি করা হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। ফলে লাভের বদলে প্রতিদিন হচ্ছে লোকসান। আমরা এই প্রকল্পের বিপুল ক্ষতি কমিয়ে আনতে কাজ করছি।

সম্প্রতি একটি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সড়ক পরিবহণ উপদেষ্টা।

উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশে, লোক দেখানো একটি প্রকল্প। অন্য দেশে টানেল আছে, আমাদের নদীর তলদেশে একটা টানেল থাকবে না, তা কী হয়! এসব দাম্ভিকতা থেকেই কর্ণফুলী টানেলটি করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে এই উপদেষ্টা বলেন, একটা প্রকল্প নিতে হবে তাই নিয়ে নিল, কারণ প্রকল্প নিলেই তো লাভ। যার ফলে দেশের চিন্তা না করে যারা কাজটি করেছে, তাদের লাভের আশার কারণে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।

সড়ক পরিবহণ উপদেষ্টা বলেন, সঠিকভাবে কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এত বড় একটা প্রকল্প সম্পন্ন করে ফেলল। ফলে প্রতিদিন লাভের বদলে প্রচুর টাকা লোকসান হচ্ছে। টানেল নির্মাণের আগের সমীক্ষা অনুযায়ী যানবাহন চলাচলের যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

উপদেষ্টা বলেন, টানেলের উচ্চতা কম হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সড়কের ওপর কোনো ফ্লাইওভার বা সমজাতীয় অবকাঠামো করলে যানবাহন নির্বিঘ্নে পারাপারের জন্য সেটির উচ্চতাও এ মানদণ্ড অনুযায়ী করা হয়। অথচ কর্ণফুলী টানেলে হেডরুম রাখা হয়েছে ৪ দশমিক ৯ মিটার। উচ্চতা কম হওয়ায় টানেল দিয়ে ভারী কার্গোর মতো যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকারও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পে কেন এত লোকসান হচ্ছে এবং কী করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা তা নিয়ে পর্যালোচনা করছি। আমরা এখন সড়ক ও সেতু দুটা বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে স্ট্রাটেজি ঠিক করব। সড়ক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সংকট কাটানোর চেষ্টা করা হবে। অন্যান্য সড়কের সঙ্গে টানেলের সংযোগ বাড়ানো হবে।

উপদেষ্টা ফাওজুল বলেন, আমরা দেখছি কী করলে ট্রাফিক বাড়বে। সেটার জন্য নতুন করে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে সেটা আমরা দেখব। তবে আমরা কোনো কাল্পনিক সংখ্যা দিয়ে সমীক্ষা করব না। কারণ আমাদের তো লোন পরিশোধ করতে হবে।

এ ছাড়া এই টানেল ঘিরে পর্যটন শহর কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপনের কথা ছিল, তা দৃশ্যমান নয়। ফলে টানেল দিয়ে গণপরিবহণ তেমন চলছে না। টানেল নির্মাণে বাড়তি খরচ করা হয়েছে। কিন্তু আয় হচ্ছে কম।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর এই টানেল উদ্বোধনের পর থেকে দৈনিক আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে টানেল কর্তৃপক্ষ, তাতে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিদিন আয়ের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি খরচ।

সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। যার মধ্যে মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ শতাংশ। আর অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম।

টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি।

সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উদ্বোধনের পর প্রথম মাসে (নভেম্বর) টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। সে হিসেবে ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে ৫ হাজার ৫৪৪টি। এতে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিল মাসে গাড়ি চলাচল করেছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৮টি। সেই হিসাবে দৈনিক গাড়ি চলেছে ৩ হাজার ৮৫৫টি। চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসের প্রথম ২১ দিনে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ৬৪ হাজার ৫৪৯টি। সেই হিসাবে সেপ্টেম্বরে দৈনিক গাড়ি চলেছে তিন হাজার ৭৩টি। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে টানেলে গাড়ি চলাচল কমছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গত এক বছরে এই টানেল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বর্তমানে টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। সে হিসেবে দৈনিক লোকসান ২৫ লাখ টাকার উপরে।

২০১৭ সালে কর্ণফুলী টানেল চালু হবে ধরে নিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যান চলাচলের প্রাক্কলন করেছিল চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যেখানে বলা হয়েছিলে, ২০২০ সালে টানেল চালু হলে দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলবে। প্রতি বছর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। ২০৩০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াবে দিনে প্রায় ৩৮ হাজার।

২০২০ সালের জায়গায় টানেল চালু হয়েছে ২০২৩ সালে। সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে চালুর পর গত আগস্ট পর্যন্ত দিনে যানবাহন চলেছে গড়ে ৪ হাজার ৬১৩টি করে। টোল আদায় হচ্ছে দিনে গড়ে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে অধিকাংশই পর্যটকবাহী পরিবহন। গত ছয়মাসে চলাচল করা যানবাহন আরও কমেছে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাসিনা পালালেও তার সিস্টেম রয়ে গেছে: আখতার হোসেন Jul 12, 2025
img
৩ মাস আগেই জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে মতামত দিয়েছে বিএনপি: তারেক রহমান Jul 12, 2025
img
এসএসসিতে এক-তৃতীয়াংশ ফেল, অকৃতকার্যদের জন্য আরেকটি পরীক্ষা নেয়ার পরামর্শ শিক্ষাবিদদের Jul 12, 2025
img
টেক্সাসে বন্যার পর অ্যারিজোনায় দাবানল, মস্কোয় চলছে তাপদাহ Jul 12, 2025
img
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সৌদি-ইসরাইলের গোপন আলোচনা Jul 12, 2025
img
টেলিকম খাতকে করমুক্ত করতে নতুন নীতিমালা: ফয়েজ আহমদ Jul 12, 2025
img
জুলাই যোদ্ধাদের জন্য আজীবন ফ্রি চিকিৎসা সেবা ও ভাতা চালু করল সরকার Jul 12, 2025
img
টেলিকম খাতকে করমুক্ত করতেই নতুন নীতিমালা: ফয়েজ আহমদ Jul 12, 2025
কেন আত্মহত্যা নিষেধ | ইসলামিক জ্ঞান Jul 12, 2025
অনলাইন জুয়ায় আর্টিস্টদের সম্পৃক্ততা ,যা বললেন চিত্রনায়ক জয় Jul 12, 2025
গ্রাহক প্রতারিত হলে এর দায় সেলিব্রেটি নেয় কিনা ! Jul 12, 2025
নির্বাচকদের নজরে আছে সাকিব, ইফতেখার মিঠু Jul 12, 2025
ন্যাটোর সহায়তায় ইউক্রেনকে অস্ত্র দেবে যুক্তরাষ্ট্র Jul 12, 2025
নির্বাচন সন্নিকটে, কবে ফিরছেন তারেক রহমান? Jul 12, 2025
img
ফরিদপুরে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার Jul 12, 2025
img
বিমান চলাচলে বিঘ্নকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি Jul 12, 2025
img
নিরাপত্তা জোট গঠন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানকে সতর্ক করল রাশিয়া Jul 12, 2025
img
স্বামী-শাশুড়ির সাথে হাসপাতালে কিয়ারা আদভানি Jul 12, 2025
img
মেট্রোরেলের পিলারে গ্রাফিতিতে ফিরে দেখা 'জুলাই ইতিহাস' Jul 12, 2025
img
চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২৩ Jul 12, 2025