শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলার বাজারে ভারতীয় শাড়ির সমাহার

বাংলাদেশ ও ভারতের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য পরিসংখ্যানে দেশটি থেকে শাড়ি আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও এ দেশের বিপণিবিতানগুলোয় প্রতিদিনই কেনাবেচা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় শাড়ি। শাড়ি বিক্রেতা এবং আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন যেসকল ভারতীয় শাড়ি বাংলাদেশের বাজারগুলোতে দেখা যায়, তার বেশিরভাগই অবৈধভাবে ও অননুমোদিত পন্থায় দেশে প্রবেশ করেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ভারত থেকে শাড়ি স্থল, নৌ ও আকাশ—এ তিন পথেই প্রবেশ করে। শুল্কমুক্ত বিভিন্ন পণ্যের চালানের মধ্যেও স্থল বা নৌ পথে বিপুল পরিমাণ শাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিশেষ করে স্থল ও নৌপথে যন্ত্রাংশবাহী যেসব কনটেইনার বাংলাদেশে আসে, সেগুলোর সঙ্গেও প্রচুর শাড়ি আসার তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভারতীয় অংশে জাহাজীকরণ তথ্যে শাড়ি রপ্তানির বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ অংশে তার কোনো উল্লেখ থাকে না।

চোরাচালানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভারতীয় শাড়ি সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে প্রবেশ করে প্রধানত বাহক বা এজেন্টদের মাধ্যমে। নৌপথে আনা হয় ট্রলারের মাধ্যমে। ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব শাড়ি দেশে প্রবেশ করে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে। সীমান্ত এলাকা থেকে তা বিভিন্ন রুট ধরে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চোরাইপথে প্রবেশ করা এসব শাড়ি এনে জড়ো করা হয় বস্ত্র ও পোশাকের বৃহৎ কয়েকটি পাইকারি বিপণিবিতানে। সেখান থেকে অন্যান্য বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী তা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। আবার চাহিদা ও দাম বেশি হলে আকাশপথেও শাড়ি আনা হয়। সেক্ষেত্রে উড়োজাহাজে শাড়ি আনা হয় ব্যক্তিগত পণ্য হিসেবে বাড়তি ওয়েট চার্জ (ওজনের ফি) পরিশোধ করে।

গত বছরের অক্টোবের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বেশকিছু ভারতীয় শাড়ি ও মখমলের কাপড় জব্দ করে কোস্টগার্ড। সে সময় বাহিনীটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাথরবোঝাই একটি ট্রাক জব্দ করে সেখানে তল্লাশি চালিয়ে আমদানীকৃত পাথরের নিচে লুকিয়ে রাখা ২ হাজার ২১০ পিস শাড়ি ও তিন হাজার গজ মখমল জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত মালামালসহ ট্রাকটি ফতুল্লা থানায় হস্তান্তর করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ভারতের কলকাতা বা অন্যান্য এলাকায় গিয়ে শাড়ির নকশা পছন্দ করে আসেন। এর পর চালান প্রস্তুত হলে প্রক্রিয়াটিতে যুক্ত হন মধ্যবর্তী এজেন্টরা। তারাই সীমান্ত দিয়ে শাড়ি পরিবহন করে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্যে পৌঁছে দেন। গোটা প্রক্রিয়াটিতে লেনদেন হয় প্রধানত হুন্ডির মাধ্যমে। রাজধানীর অভিজাতসহ ছোট-বড় সব বিপণিবিতানেই ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হতে দেখা গেছে। এসব দোকানের বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনানুষ্ঠানিক পথে বা অবৈধভাবে এসব শাড়ি দেশে প্রবেশের বিষয়টি এখন এক প্রকার ওপেন সিক্রেট। আবার বিষয়টির এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়ে গেছে।

আমদানি ও রফতানিতে পণ্যের পরিচয় নিশ্চিতে ব্যবহার করা হয় হারমোনাইজড সিস্টেম বা এইচএস কোড। বাংলাদেশে শাড়ির এইচএস কোড ৫২.০৮। আর ভারতে পণ্যটির এইচএস কোড ৫২০৯৪১২০। ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২২-২৩ ছাড়া গত পাঁচ অর্থবছরের চারটিতেই ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শাড়ি আমদানি করেনি বাংলাদেশ। সেবার আমদানির পরিমাণও ছিল খুবই যৎসামান্য। মাত্র ৯০ হাজার ডলার মূল্যের শাড়ি আমদানি হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ভারত বাংলাদেশে পণ্য রফতানি করেছে ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে শাড়ির অংশ শূন্য। একই চিত্র বাংলাদেশের সরকারি তথ্যেও।

ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পরিচালক সৌমিক দাস বলেন, ‘আমরা আসলে জানতে চাই কীভাবে এত শাড়ি আসে বাংলাদেশে? আর দামও কীভাবে এতটা কম হয়? এর কারণ হচ্ছে, তা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আসে, এর জন্য কোনো করও দিতে হয় না। দেশী শিল্পে এর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশে আমরা কয়েক ধরনের শোপিস তৈরি করি। কিন্তু তারা আমাদের মতো হাতে তৈরি না করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেথডে কয়েক লাখ পিস তৈরি করে। দামটাও সেভাবে নির্ধারণ হয়। তাদের তৈরির উদ্দেশ্যই থাকে আমাদের এখানে পাঠানো। আবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে তৈরির কারণে তারা আমাদের থেকে কাজও একটু বেশি করে। ফলে সব দিক হিসাব করলে আমরা তো সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমাদের এখানে আমরা ১০০-২০০ পিস তৈরি করতে যে খরচ, তাদের তো সেই খরচ হয় না।’

বাংলাদেশে ভারত থেকে আনা শাড়ির বৃহদংশ প্রবেশ করে স্থল সীমান্ত দিয়ে। আবার নৌপথও ব্যবহার হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ২৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থল সীমান্ত ১৩৮ কিলোমিটার। আর জলসীমান্ত ১০০ কিলোমিটার। স্থানীয়রা জানালেন, বিশাল এ সীমান্ত দিয়ে অবৈধপথে বাংলাদেশে ভারতীয় বি‌ভিন্ন ধরনের শাড়ি। সীমা‌ন্তবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দারা জানালেন, বি‌জি‌বি, পু‌লিশ ও কাস্টমসের চোখ ফাঁ‌কি দিয়ে চোরাকারবারি বা লাগেজ পা‌র্টি এসব শাড়ি অবৈধভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। এর পর তা সরবরাহ হচ্ছে রাজধানীসহ বি‌ভিন্ন জেলায়। এছাড়া ভোমরা স্থলবন্দর সংলগ্ন ও সাতক্ষীরা শহরের বড় বিপণিবিতানগুলোয় তা বিক্রি করছে।

সবচেয়ে ‌বে‌শি চোরাচালান হয় সুন্দরবন সংলগ্ন বি‌ভিন্ন নদীপথে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা ৩৩ বি‌জি‌বির এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, দীর্ঘ সীমান্ত পথে কখনো কখনো বি‌জি‌বির চোখ ফাঁ‌কি দিয়ে শাড়ি বা অন‌্যান‌্য সামগ্রী ঢুকে পড়তে পারে। তবে বি‌জি‌বির পক্ষ থেকে সব ধরনের চোরাচালান রোধে কড়া নজরদা‌রি চালু আছে।

বাংলাদেশ-ভারতের বহুল ব্যবহৃত সীমান্ত যশোরের বেনাপোল-পেট্রাপোল। এ সীমান্ত দিয়েও বিপুলসংখ্যক শাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমের অতিরিক্ত কমিশনার শরিফুল হোসেন বলেন, ‘অনেক যাত্রী ভারত থেকে কসমেটিক্স, কাপড় ও কম্বল নিয়ে আসেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অতিরিক্ত মালামাল আনলে আমরা তাদেরকে আটক করছি।’ যশোর বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা দিয়ে কসমেটিক্স ও কাপড় নিয়ে যারাই আসছেন, খবর পেলে আমরা তাদেরকে আটক করছি। গত এক বছরে আমরা বিপুল পরিমাণ কাপড় আটক করেছি।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত দিয়ে আনা হয় বলে সরকারি আমদানি তথ্যে শাড়ির পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। অনেকে ভ্রমণে গিয়ে লাগেজে করে আনেন। তবে সেখানে খুব বেশি আনা যায় না। ফলে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ভারতে গিয়ে আগে পছন্দ করে সেখানে অর্ডার করে আসে। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট এজেন্টরা বাংলাদেশে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। ফলে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেয়া যায় সহজে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ফের দুর্ঘটনা, নিহত আরও ৩ Aug 22, 2025
img
চট্টগ্রামে মিষ্টিমুখ কারখানায় অভিযান, এক লাখ টাকা জরিমানা Aug 22, 2025
img
আল্লু অর্জুন-অ্যাটলির যুগলবন্দিতে নতুন মাত্রা পাচ্ছে দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রি Aug 22, 2025
img
সুর-নাচ-রঙে ভরপুর, ‘ডেঞ্জার’ গানে নেট দুনিয়ায় উচ্ছ্বাস Aug 22, 2025
img
নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যে পাঁচ বাংলাদেশি ফুটবলার Aug 22, 2025
img
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ৫৮% মার্কিনি : রয়েটার্স Aug 22, 2025
img
জুলাই শহীদ পরিবার পাবে এককালীন ৩০ লাখ টাকা সহায়তা ও মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা Aug 22, 2025
img
সারা দেশ ডাকসুর দিকে তাকিয়ে আছে : এ্যানি Aug 22, 2025
img
জিম্বাবুয়ে সফরে শ্রীলঙ্কা, চোটে ছিটকে গেলেন হাসারাঙ্গা Aug 22, 2025
img
মহাখালীতে শতাধিক অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করল ডিএনসিসি Aug 22, 2025
img
ট্রাম্পের শুল্ক চাপের মধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর বার্তা দিল ভারত Aug 22, 2025
img
আগামী নির্বাচন অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে : মুফতি ফয়জুল করীম Aug 22, 2025
img
হেরোপান্তি থেকে বাঘি ৪, সজিদের হাত ধরে বলিউডে নতুন মুখ Aug 22, 2025
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীসংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা তুলসী গ্যাবার্ডের Aug 22, 2025
নির্বাচন নিয়ে শর্ত জনগণের উদ্বেগের কারণ: তারেক রহমান Aug 22, 2025
img
হায়দরাবাদে ফিরছেন এনটিআর, শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী অ্যাকশন শিডিউল Aug 22, 2025
মাদ্রাসা প্রধানদের জন্য প্রশাসনের কঠোর সতর্কতা! Aug 22, 2025
img
খুলনায় ভৈরব নদে ফেরি-ট্রলার সংঘর্ষে ৩ জন নিখোঁজ Aug 22, 2025
img
হিলি স্থলবন্দরে ১ দিনেই রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি Aug 22, 2025
ক্রিপ্টোকারেন্সি এখন বিনিয়োগের নতুন ট্রেন্ড! Aug 22, 2025