পাঞ্চেন লামাকে ২২ বছর ধরে আটকে রেখেছে চীন

তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পাঞ্চেন লামা। যাকে ১৯৯৫ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে আটক করে চীন। তাকে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী রাজনৈতিক বন্দি বলেও মনে করা হয়।

আটকের পর ২৪ বছর পার হয়ে গেলেও তাকে জনসম্মুখে আনেইনি চীন। এমনকি তার কোনো সঠিক তথ্যও দেয়নি চীনা কর্তৃপক্ষ। আর এই ব্যাপারটি বৌদ্ধ ধর্মকে একটি জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পাঞ্চেন লামা কেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?

বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী কেউ মারা গেলে তার পুনর্জন্ম ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের শীর্ষ গুরু হলো- দালাই লামা ও দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ গুরু পাঞ্চেন লামা ।

দালাই লামাকে বুদ্ধের দয়ার অবতার মনে করা হয় আর পাঞ্চেন লামাকে সীমাহীন আলোকবর্তিকা মনে করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে তারা একজন অপরজনের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন এবং অপরজনের পুনর্জন্মকারীকে খুঁজে বের করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পাঞ্চেন লামা ১৯৮৯ সালে যখন রহস্যজনক কারণে মারা যান (অনেকে মনে করেন যে, চীনা সরকার তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে)। তার ঠিক ছয় বছর পর ১৯৯৫ সালের ১৪ মে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর প্রধান গুরু দালাই লামা ঘোষণা দেন যে, পাঞ্চেন লামার নতুন দেহধারীকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। সে হলো তিব্বতের নকচু শহরের একজন চিকিৎসক ও সেবিকা দম্পতির ছয় বছরের ছেলে গিনডু চোকি নিমা। তারপর থেকেই তার গুরুত্ব বেড়ে যায়।

কেন তাকে আটক করে চীন?

চীন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য তিব্বতিরা দালাই লামার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করতে না পেরে দালাই লামা ১৯৫৯ সালে তিব্বত ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে প্রবাসী তিব্বতি সরকার গঠন করেন।

চীনের সরকার আশা করছিল, যদি নতুন পাঞ্চেন লামাকে খুঁজে বের করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যুদ্ধ থেকে নিভৃত করা যাবে। তাই গিনডু চোকি নিমা এবং তার পরিবারকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় চীন এবং কিছু অনুগত বুদ্ধ নেতাদের সহায়তায় আরেকটি ছেলেকে পুতুল পাঞ্চেন লামা হিসেবে নির্বাচিত করে।

কোথায় আছেন পাঞ্চেন লামা?

পাঞ্চেন লামা কোথায় আছে তা নিয়ে ধোঁয়াশার শেষ নেই।  সাউথ চায়না মনিং পোস্টকে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি এখন চীনের উত্তরাঞ্চলের গ্যানসুতে বসবাস করেন। আরেকটি ধারণা হলো যে, তাকে বেইজিং এর আশেপাশে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে।

২০০০ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক হাউজ অব কমন্সের বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণ কমিটিকে বলেছেন, 'যতবার আমরা গিনডু চোকি নিমার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছি, চীন সরকার আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, তিনি সুস্থ শরীরে রয়েছেন এবং তার যত্ন নেয়া হচ্ছে। তবে তার পিতামাতা এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চান না।'

তিনি আরও জানান, 'গত সপ্তাহের সর্বশেষ বৈঠকে তারা (চীন) দুইটি ছবি দেখিয়েছে, যাতে আমরা গিনডু চোকি নিমাকে তার বাড়িতে রয়েছেন বলে দেখানো হচ্ছে। তবে এগুলো আমরা নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারিনি।'

ছবি দুটি নিয়ে রবিন কুক বলেন, ২০০০ সালে ওই বালকের বয়স হওয়ার কথা ১১ বছর। একটি ছবিতে দেখা গেছে সে টেবিল টেনিস খেলছে। আরেকটি ছবি তার পেছন দিক থেকে তোলা, যেখানে সে ব্লাকবোর্ডে চীনা ভাষায় কিছু লিখছে। ছবিগুলো দেখানো হলেও সেগুলো হস্তান্তর করা হয়নি।

সর্বশেষ ছবি কোথা থেকে এসেছে?

এই লেখার শুরুর ছবিটি এসেছে ফরেনসিক শিল্পী টিম উইডেনের বয়স-অগ্রগতি ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দালাই লামার অনুসন্ধানী দল ১৯৯৪-৯৫ সালে গিনডু চোকি নিমাকে খুঁজে বের করার পর যে ছবি তোলে, সেটিই তার একমাত্র ছবি।

পাঞ্চেন লামার ৩০তম জন্মদিন উপলক্ষে ওই ছবিটিকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান চেহারা বের করার চেষ্টা করেছেন টিম উইডেন। এই পদ্ধতিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেক ছবি, বাবা-মা বা ভাই-বোনদের চেহারা বিবেচনায় নিয়ে বের করা হয়। কিন্তু পাঞ্চে লামার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি ছবির ওপর ভিত্তি করে বর্তমান চেহারা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই ছবিটি ইন্টারন্যাশনাল টিবেট নেটওয়ার্কের জন্য চারবছর আগে তৈরি করা হয়। পাঞ্চেন লামার নিখোঁজ হওয়ার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি তৈরি করা হয়েছিল, তখন তার বয়স হওয়ার কথা ২৬ বছর।

ছবিটিতে তাকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো একটি চাদর পরে থাকতে দেখা যায়, যদিও তিনি এরকম ধর্মচর্চা করার সুযোগ পান কিনা, তার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

পাঞ্চেন লামাকে ছাড়া কি আরেকজন দালাই লামা সম্ভব?

ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর টিবেটের ভাইস-প্রেসিডেন্ট বৌচুং সেরিং বলেন, যদিও দালাই লামার পুনর্জন্মকারীকে খুঁজে বের করতে গুরুত্বপূর্ণ পালন করেন পাঞ্চেন লামা, কিন্তু এই কার্যক্রমে তিনি একাই সব নন ।

তবে তিনি ধারণা করেন, যখন সেই সময় আসবে, তখন চীনা কর্তৃপক্ষ 'হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তাদের পছন্দের কোন ব্যক্তিকে পাঞ্চেন লামা হিসাবে বাছাই করবে'।'

২০১৯ সালের মার্চে রয়টার্সকে দালাই লামা বলেছেন, তার উত্তরসূরিকে ভারতে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, যেখানে তিনি এবং অন্য অনেক তিব্বতি প্রায় ৬০ বছর ধরে বাস করছেন।

তিনি আরও বলেছেন, এ বছরের শেষের দিকে তিব্বতের বুদ্ধদের সঙ্গে ভারতে একটি বৈঠক হবে, যেখানে আলোচনা হবে যে, আদৌ আর দালাই লামার প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে কিনা।

 

টাইমস/এএইচ/এসআই

Share this news on: