বেশ কয়েক মাস অসুস্থ ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস।এখন মৃত্যুর পর অনেক নিয়ন-নীতি মেনে পোপের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। নতুন পোপ হবেন ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মযাজকদের ভোটে। দুটি প্রক্রিয়াই বেশ জটিল।
৮৮ বছর বয়সে লোকান্তরিত হওয়া ফ্রান্সিস ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার কোন দেশ থেকে আসা প্রথম পোপ। আজ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া তৃতীয় গ্রেগরি ৭৪১ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার পর থেকে রোমে ইউরোপের বাইরে থেকে আর কোনো বিশপ ছিল না।
ক্যাথলিক চার্চের পোপ হওয়ার পর অনেক কিছুই প্রথমবার করলেও ফ্রান্সিস কখনও চার্চের সংস্কার কার্যক্রম বন্ধ করেননি।
এরপরও পুরনোকে আঁকড়ে ধরা ঐহিত্যবাদীদের মধ্যেও তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুতে ক্যাথলিক খ্রিস্টান বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
মৃত্যুর আগে প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি রোমান ক্যাথলিক চার্চের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার মৃত্যুর পর এখন নতুন করে পোপ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকশ' বছরের পুরনো রীতি অনুসরণ করে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু নির্বাচন করা হবে।
পোপের মৃত্যুর পর কী করা হয়?
মৃত্যুর পর বেশকিছু নিয়ন-নীতি মেনে পোপেরও শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ঐতিহ্যগতভাবে পোপের শেষকৃত্যের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল।
তবে মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে পোপ ফ্রান্সিস তার শেষকৃত্যের প্রক্রিয়াটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত করার পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়ে গেছেন।
এর আগে যত পোপ মারা গেছেন, তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে সাইপ্রেস কাঠ, ওক কাঠ এবং সীসা দিয়ে তৈরি কফিনে। পোপ ফ্রান্সিস সেখানে দস্তা দিয়ে আবৃত একটি সাধারণ কাঠের কফিন বেছে নিয়েছেন।
সমাহিত করার আগে সর্বসাধারণের দেখার জন্য পোপের দেহকে এতদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম, যা ক্যাটাফাল্ক নামে পরিচিত, সেখানে রাখা হতো।
সেই ঐতিহ্য ভেঙে পোপ ফ্রান্সিস নিজের মরদেহ কফিনের ভেতরে রেখে ঢাকনা খুলে রাখতে বলে গেছেন, যাতে শোকাহত ব্যক্তিরা সহজে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সমাধিস্থ করা হয়। তবে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে ফ্রান্সিসই হতে যাচ্ছনে প্রথম কোনো পোপ, যাকে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হবে।
পোপ ফ্রান্সিসের নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে রোমের অন্যতম প্রধান ব্যাসিলিকা সেন্ট মারি মেজরে সমাহিত করা হবে।
ব্যাসিলিকা হলো এমন একটি গির্জা, যেটিকে বিশেষ তাৎপর্য স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ভ্যাটিকান। মেজর ব্যাসিলিকার সঙ্গে পোপের একটি বিশেষ সংযোগ রয়েছে।
নতুন পোপ নির্বাচন করেন কারা?
ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মযাজক, যারা 'কলেজ অব কার্ডিনালস' নামে পরিচিত, তারাই ভোট দিয়ে নতুন পোপ নির্বাচন করেন।
এসব কার্ডিনালদের সকলেই পুরুষ। তারা সরাসরি পোপ কর্তৃক বিশপ হিসেবে নিযুক্ত হন।
বর্তমানে মোট ২৫২ জন ক্যাথলিক কার্ডিনাল রয়েছেন, যাদের মধ্যে নতুন পোপ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন ১৩৫ জন।
অন্য কার্ডিনালদের বয়স ৮০ বছরের বেশি হওয়ায় তারা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে নতুন পোপ হিসেবে কাকে নির্বাচিত করা উচিত, সেই বিতর্কে অংশ নিয়ে তারা নিজেদের মতামত জানাতে পারবেন।
নতুন পোপ বেছে নেওয়া হয় কীভাবে?
যখন একজন পোপ মারা যান (অথবা পদত্যাগ করেন, যেমনটি ২০১৩ সালে পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যেটি ছিল বিরল ঘটনা), তখন ভ্যাটিকানে কার্ডিনালদের একটি সম্মেলন ডাকা হয়।
তারপর কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়, যেটি পোপ নির্বাচনের সময় হিসাবে পরিচিত।
বর্তমান পোপের মৃত্যুর পর থেকে নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়কালে 'কলেজ অব কার্ডিনালস'ই গির্জার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পোপ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয় চিত্রশিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর চিত্রাঙ্কন শোভিত বিখ্যাত সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সেখানে কার্ডিনালরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।
নতুন পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যেতে পারে।
অতীতে এক সপ্তাহ, এমনকি এক মাস সময় ধরেও ভোট চলতে দেখা গেছে। ভোট চলাকালে কার্ডিনালদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন, এমন নজিরও আছে।
এই সময় নতুন পোপ নির্বাচন কতটুকু এগোলো, সেটি বোঝার একমাত্র উপায় হলো ধোঁয়া। নির্বাচন চলাকালে প্রতিবার ভোট শেষে নির্দিষ্ট চুল্লিতে ব্যালট পেপার পুড়িয়ে ফেলা হয়।
এর ফলে দিনে দু'বার যে ধোঁয়া বের হয়, সেটিই নতুন পোপের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়।
কালো ধোঁয়ার অর্থ হলো পোপ নির্বাচন হয়নি। আর সাদা ধোঁয়া দেখার মানে হলো নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন।
নতুন পোপের ঘোষণা আসে যেভাবে
সাদা ধোঁয়া দেখা যাওয়ার পর সাধারণত ঘন্টাখানেকের মধ্যে নতুন পোপ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
এরপর কনক্লেভে অংশগ্রহণকারী একজন জ্যেষ্ঠ কার্ডিনাল আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন পোপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান। তিনি ল্যাটিন ভাষায় চিৎকার করে বলেন, “হ্যাবেমাস পাপাম”, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, “আমাদের একজন পোপ আছেন।”
কার্ডিনাল এরপর নতুন পোপের নাম ঘোষণা করেন। এসময় নতুন পোপকে যে নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, সেটি সাধারণত তার আসল নাম হয় না। পোপরা সবসময় ল্যাটিন নাম গ্রহণ করেন।
পোপ ফ্রান্সিসই এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। তার প্রকৃত নাম ছিল জর্জ মারিও বার্গোগলিও। কিন্তু তের শতকের ধর্মপ্রচারক ও প্রাণী প্রেমিক অ্যাসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি নিজের নতুন নাম নেন 'পোপ ফ্রান্সিস।”
গত এক যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে তিনি ওই নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
পোপ হওয়ার যোগ্যতা কী?
তাত্ত্বিকভাবে বললে বলা যায়, ব্যাপ্টাইজ বা বাপ্তিস্ম হওয়া যে কোনো রোমান ক্যাথলিক পুরুষই পোপ হতে পারেন; তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্যাটিকানের কার্ডিনালরা তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজনকে পোপ হিসেবে বেছে নিতে পছন্দ করেন।
পোপ ফ্রান্সিস নামে পরিচিত জর্জ মারিও বার্গোগোলিও ২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পোপ নির্বাচিত হন। দক্ষিণ আমেরিকা, যেখানে বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টান বসবাস করে, সেখান থেকে প্রথমবারের মতো পোপ নির্বাচিত হন ফ্রান্সিস।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নতুন পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কার্ডিনালরা সাধারণত একজন ইউরোপীয়, বিশেষ করে একজন ইতালিয়কেই বেছে নেন।
এখন পর্যন্ত নির্বাচিত ২৬৬ জন পোপের মধ্যে ২১৭ জনই এসেছেন ইতালি থেকে।
পোপের কাজ কী?
পোপ হলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু। রোমান ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি যীশু খ্রিস্টের বংশধারার সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করেন। তাকে সেন্ট পিটারের জীবন্ত উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ধর্মপ্রচার শুরু করার প্রথমদিকে যে কয়েকজন ব্যক্তি যীশু খ্রিস্টের শিষ্যত্ববরণ করেছিলেন, সেন্ট পিটার তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাকে খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকদের নেতা মানা হয়।
ফলে সেন্ট পিটারের জীবন্ত উত্তরসূরি হিসেবে একজন পোপ বিশ্বের সমস্ত ক্যাথলিক গির্জার প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা নিযুক্ত হন।
গির্জাগুলোর পাশাপাশি সারা বিশ্বের প্রায় একশ' চল্লিশ কোটি ক্যাথলিক খ্রিষ্টান তার নির্দেশনা মেনে ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করে থাকে।
খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা সাধারণত বাইবেলের পরামর্শ মতোই জীবন যাপনের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তারা পোপের কাছ থেকে ধর্মীয় বিভিন্ন শিক্ষা-দীক্ষা ও পরামর্শ পেয়ে থাকেন।
সারা বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মের যত অনুসারী রয়েছেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই রোমান ক্যাথলিক। এর বাইরে, প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্সসহ আরও বেশ কয়েক ধরনের খ্রিস্টান রয়েছেন, তবে তারা পোপের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেন না।
পোপের বসবাস বিশ্বের সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটিতে, যার চারপাশ ইতালির রাজধানী রোম দিয়ে বেষ্টিত।
ধর্মগুরু হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য পোপ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বেতন পান না। তবে তার জীবনযাপন ও ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল খরচ ভ্যাটিকান সিটি বহন করে থাকে।
এসএম/টিএ