ট্রাম্পের সফরে বদলে গেল মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক মানচিত্র

এই সপ্তাহে একটি দৃশ্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একাকীত্বকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, তা হলো—সিরিয়ার ইসলামপন্থী নেতা আহমেদ আল-শারার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করমর্দনের ছবি। শারাকে ইসরায়েল তাকে ‘স্যুট পরা আল কায়েদা সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে। ও একজন সত্যিকারের নেতা। ’

বুধবার রিয়াদে শারার সঙ্গে বৈঠকের পর এই মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প। এই বৈঠকটি আয়োজন করে সৌদি সরকার, যাদের সঙ্গে ট্রাম্প বিপুল অস্ত্র, ব্যবসা এবং প্রযুক্তি চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক মানচিত্র আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যে চার দিন সফর শেষে এমন মনোভাবই প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্পের সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরটি শুধু কূটনৈতিক প্রদর্শনী ছিল না, বরং এটি একটি নতুন সুন্নি নেতৃত্বের উদয়ের ঘোষণা দিয়েছে—ফলে ইরানের প্রভাব আর আগের অবস্থায় থাকবে না এবং অন্যদিকে ইসরায়েলকে একপ্রকার উপেক্ষিত করা হয়েছে। এমনটাই বলছেন তিনজন আঞ্চলিক ও দুইজন পশ্চিমা সূত্র।

গাজায় যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রতি বিরক্তি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের এই সফর নেতানিয়াহুর জন্য একপ্রকার অপমান ছিল। এই নেতানিয়াহুই জানুয়ারিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন।

সূত্রগুলো বলছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গঠিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতানিয়াহু আর শর্তহীন মার্কিন সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে পারেন না।

সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড শেনকার বলেছেন, ‘এই প্রশাসন নেতানিয়াহুর ওপর অত্যন্ত হতাশ, এবং সেটাই এখন পরিষ্কার।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওরা খুব লেনদেন নির্ভর। কিন্তু নেতানিয়াহু এখন তাদের কিছুই দিচ্ছেন না।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনই ইসরায়েলকে পরিত্যাগ করতে যাচ্ছে না, কারণ দেশটি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ, দ্বিদলীয় সমর্থনপুষ্ট মিত্র। তবে হোয়াইট হাউজ নেতানিয়াহুকে এই বার্তাটিই দিতে চায়—মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে এবং নেতানিয়াহু যেন তার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ান।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে নেতানিয়াহুর অনড়তা এবং ইরানের সঙ্গে মার্কিন পারমাণবিক আলোচনার বিরোধিতাও ওয়াশিংটনের ধৈর্যচ্যুতির কারণ। নেতানিয়াহুর অফিস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি এবং ট্রাম্পের সফর সম্পর্কেও কোনো বক্তব্য দেয়নি।

হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক মুখপাত্র জেমস হিউইট বলেন, ‘ট্রাম্প ইসরায়েলের বন্ধু। আমরা গাজায় বাকি জিম্মিদের মুক্তি, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন রোধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ তবে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা গাজা ও ইরান ইস্যুতে নেতানিয়াহুর অবস্থানে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

ট্রাম্পের সফরের আগেই যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। গত এপ্রিল মাসে নেতানিয়াহু দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য মার্কিন সমর্থন চাইলেও হতাশ হন। বৈঠকের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে জানতে পারেন—যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক পথে হাঁটছে।

পরবর্তীকালে ইয়েমেনে হুতিদের সঙ্গে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, সিরিয়ার ইসলামপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে পুনর্মিলন এবং উপসাগরীয় সফরে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করাই বোঝায়—পূর্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখন আর আগের মতো নেই।

নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন, হোয়াইট হাউজে ফিরে যাওয়ার আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি চান। কিন্তু তিনি দায়িত্ব গ্রহণের মাস কয়েক পরেও নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির ডাকে সাড়া না দিয়ে হামলা অব্যাহত রেখেছেন। যুদ্ধ চলছে প্রায় ১৯ মাস ধরে, গাজায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫২ হাজার ৯০০।

এই যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণ দিয়ে—যেখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫০ জন জিম্মি হয়।

ট্রাম্প এই সফরের মাধ্যমে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও তা সফল হয়নি। বরং নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত এবং নিজ দেশে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েও হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্প সফর শেষ করার ঠিক পরের দিন ইসরায়েল গাজায় নতুন অভিযান শুরু করে।

এদিকে নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থানের কারণে ট্রাম্পের আরেকটি অগ্রাধিকার প্রকল্প—সৌদি আরবকে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় আনাও থমকে গেছে। সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধ থেমে না গেলে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথে অগ্রগতি না হলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হবে না।

ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে রেকর্ড ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছেন, যা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

তিনি সৌদি আরবকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে সময় নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং এখন সৌদিদের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পারমাণবিক বিনিয়োগ চুক্তিও আলোচনা করছেন—যা ইসরায়েলের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

গালফ রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের কূটনৈতিক লক্ষ্য পূরণে এগোচ্ছে। সৌদি আরবের অনুরোধে এবং ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ইতিপূর্বে শারার মাথার জন্য ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তার সঙ্গেই বৈঠক করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ইয়েমেনে হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিও ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ দুর্বল করার কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই ঘোষণা আসে এমন সময়ে, যখন হুতিদের একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে আঘাত হানে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, ‘ইসরায়েল এখন এমন একটি দেশের মতো দেখাচ্ছে, যে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন কৌশলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

নেতানিয়াহুর সরকার ট্রাম্পের সফর নিয়ে নিশ্চুপ থাকলেও, ইসরায়েলি গণমাধ্যম এবং বিরোধী রাজনীতিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ট্রাম্প এখনও ইসরাইলের বন্ধু। তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু দাবি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য আমাদের চোখের সামনে ভূমিকম্পের মতো বদলে যাচ্ছে, আমাদের শত্রুরা শক্তিশালী হচ্ছে, অথচ নেতানিয়াহু এবং তার গোষ্ঠী যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত—নীরব, নিষ্ক্রিয়।’

সূত্র : রয়টার্স

Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রতিটি হামলার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন জড়িত : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন Jul 12, 2025
img
ফেনীতে বন্যার পানি নামছে, ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতি Jul 12, 2025
পুলিশের সুপারশপ ঘুরে দেখলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 12, 2025
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন আইজিপি Jul 12, 2025
চট্টগ্রামে ১১ খণ্ডে বিভক্ত লাশ! স্ত্রীর মরদেহ কমোডে ফ্লাশ করলো স্বামী! Jul 12, 2025
"বাবু খেয়েছো? জিগ্যেসের জন্যতো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বানাই নাই!" Jul 12, 2025
img
'ভিডিওতে থাকলেও আমি কাউকে মারিনি' মিডফোর্ডের ঘটনার আসামী টিটন Jul 12, 2025
img
অতিরিক্ত সচিবসহ তিনজনকে ওএসডি Jul 12, 2025
img
ঢাকায় পৌঁছালেন বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট Jul 12, 2025
img
এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য Jul 12, 2025
img
পিআর পদ্ধতি একটি অপরিকল্পিত প্রস্তাবনা মাত্র: ১২ দলীয় জোট প্রধান Jul 12, 2025
img
রিয়ালের আবেদন নাকচ করল লা লিগা সভাপতি Jul 12, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৯১ Jul 12, 2025
img
মিটফোর্ডের ঘটনায় আসামি রবিনের স্বীকারোক্তি, টিটন ৫ দিনের রিমান্ডে Jul 12, 2025
পুলিশ মেসের ওয়াশরুম ঘুরে দেখলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 12, 2025
পুলিশকে খেলাধুলায় জোর দিতে বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 12, 2025
img
লোকেরা আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল : করণ জোহর Jul 12, 2025
ইউনুস সরকারকে হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের সংস্কার প্রস্তাব Jul 12, 2025
img
নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা জানালেন উপ-প্রেসসচিব Jul 12, 2025
img
কপিল শর্মার ক্যাফেতে হামলাকারীদের দায় স্বীকার Jul 12, 2025