জুলাই-আগস্টের বীভৎসতা বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল : চিফ প্রসিকিউটর

জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

রবিবার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলে বিষয়টি নিয়ে শুনানিতে সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর এ কথা বলেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই ট্রাইবুনালের এই পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে, আমি শুধু একজন আইনজীবীই নই, ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার।’

তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশকে বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল।’

তিনি আরো বলেন, এই বিচার শুরু হলো জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে।তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায় সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ২৪-এর এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিগণ কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন।

আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেপ্তার নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেয়ার মত ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো।’
তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব, যা ‘মনসুন রেভল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত-সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে।

২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিগণের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিগণ সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওই সব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা অন্যান্য বাহিনীসমূহ এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের অধীনস্থ সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।

তিনি বলেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অফ দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করব সেগুলো হচ্ছে, প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ।’

আসামিগণের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস, ডিজিটাল এভিডেন্স সমূহের ফরেন্সিক রিপোর্ট, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি সাক্ষ্য প্রমাণে উপস্থাপন করা হবে।

তিনি বলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়।এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে-সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।’

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিচার শুরুর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সেই সব ভিকটিমদের যারা আর কোনোদিন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসবে না। স্মরণ করছি তাদেরকেও- যারা এই আন্দোলনে চোখ,হাত, পা কিংবা শরীরের অন্য কোন অঙ্গ হারিয়েছেন। স্মরণ করছি সেই সব অকুতোভয় মানুষদের, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এই রাষ্ট্র অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে-যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণ নির্ভর এবং ন্যায় ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।


এমআর/টিএ


Share this news on:

সর্বশেষ

img

সাদিক কায়েম

জুবায়ের ও সর্ব মিত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে কালচারাল ফ্যাসিস্টরা Nov 06, 2025
img
ভার্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে জয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম হাশমির Nov 06, 2025
img
বড় বাজেটের ভিড়ে ‘দ্য তাজ স্টোরি'র বাজিমাত Nov 06, 2025
img
রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি ‘ভারতের রোনালদো-মেসি' : রশিদ লতিফ Nov 06, 2025
img
অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার দল নিয়ে সমালোচনা সাবেক অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর Nov 06, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Nov 06, 2025
নিউইয়র্কে নতুন ইতিহাস, জেন-জি ফার্স্ট লেডি রামা দুওয়াজি Nov 06, 2025
সিলেট-৫ আসনে ৩০ বছরের মধ্যে প্রার্থী নেই বিএনপির Nov 06, 2025
মনোনয়ন চাপে বিএনপি, বদল হতে পারে প্রার্থী তালিকা Nov 06, 2025
রাষ্ট্র সংস্কারের জায়গায় ফেল হলে চুপ থাকবো না: এসএম ফরহাদ Nov 06, 2025
আইনি নোটিশের পরও সমাধান হয়নি, মামলা দায়ের Nov 06, 2025
জন্মদিনের পোস্টে মেয়েকে শাসন করলেন শাহরুখ Nov 06, 2025
শাকিবের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যাপিটালস এবারও হট ফেভারিট Nov 06, 2025
img
তারুণ্য নির্ভর ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই : জামায়াত আমির Nov 06, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

হলান্ড ও ফোডেনের দুর্দান্ত গোল, ডর্টমুন্ডকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিল ম্যানচেস্টার সিটি Nov 06, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

ব্রুজের মাঠে কোনোমতে হার এড়াল বার্সেলোনা Nov 06, 2025
img
আজারবাইজানি ক্লাবের সাথে ড্র করে পয়েন্ট হারাল চেলসি Nov 06, 2025
img
বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন রেজা কিবরিয়া Nov 06, 2025
img
রিয়ালের বিপক্ষে ট্যাকলে শতভাগ সফল ছিলেন ব্র্যাডলি! Nov 06, 2025
img
নিরাশা আছে, কিন্তু আমি নিরাশার প্রচারক হবো না, বললেন সংগীতশিল্পী সায়ান Nov 06, 2025