ছাত্র আন্দোলনের অগ্রদূত হাসনাতের জুলাই নিয়ে কিছু কথা

হাসনাত আব্দুল্লাহ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক। এই তরুণ সংগঠক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া আদায় এবং যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে লড়াকু হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সব সময় ছিলেন অগ্রগামী।

২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেন। সেই আন্দোলন থেকেই তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্রে পরিণত হন তিনি।

এই সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে তাঁকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের হাতে বন্দি থেকে ট্রমার মধ্য দিয়েও দিনযাপন করতে হয়। দেশের জন্য শহীদি মৃত্যু বরণ করতেও রাজি ছিলেন এই দুঃসাহসী তরুণ। তবুও স্বৈরাচারের কাছে মাথানত করেননি।

ছাত্রজীবনে একজন চৌকস বিতার্কিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন হাসনাত। যেকোনো বিতর্কে তিনি ক্ষুরধার যুক্তি ও চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরতেন। কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই তরুণ নেতার স্বপ্ন একটি ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

সম্প্রতি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।

তিনি বলেন, “আমরা ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে একটা কর্মসূচি দিই, যেটি ঢাকাসহ সারা দেশের ছাত্র জনতা ও সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে এ কর্মসূচি। পরবর্তী দুই দিন আমাদের ব্লকেড কার্যক্রম চলে। ‘বাংলা ব্লকেড’ কার্যক্রমের পরে আমরা একদিন বিরতি দিই। সেদিন আমরা আমাদের সমন্বয়ক টিমকে ভাগ করে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই, যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা ভালোমতো সমন্বয় করতে পারি। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি কুমিল্লাতে যাই।’

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলি। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেখানে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সেই স্থানগুলো পরিদর্শন করি এবং ছাত্রদের নির্দেশনা দিই। একই সঙ্গে আমরা সমন্বয়করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ওই সময় আমাদের সমন্বয়করা ছাত্রলীগ ও পুলিশের তাণ্ডবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তারাও আন্দোলনকে সমন্বয় করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে থাকে। পরবর্তীতে যেটি হয়, আন্দোলন দৃঢ় ও ইস্পাত-কঠিন হতে থাকে। সারা দেশের সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে থাকা শিক্ষার্থীরা সুসংগঠিত হতে থাকে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বয়ক নির্বাচিত করি, যাতে করে বিগত দিনের মতো অন্য শিক্ষার্থীদের ওপরেও দায় চাপিয়ে আন্দোলন বেহাত হওয়ার যে ঘটনা ঘটে, তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। পরবর্তীতে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।’

তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচিবালয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যাই। ১৪ জুলাই আমরা স্মারকলিপি দিয়ে হলে ফিরি, ওইদিন গণভবনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার একটা প্রেস কনফারেন্স ছিলো। আমরা দেখি যে সেই প্রেস কনফারেন্সে তিনি (শেখ হাসিনা) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার এমন আপত্তিকর বক্তব্যের পর ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।’

হাসনাত বলেন, ‘১৪ জুলাই রাতে সবাই যখন যার যার হল থেকে রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখন আমি একটি টিভি টকশোতে ছিলাম। টকশো শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা হই। এর মধ্যে দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণে রাতের ঢাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। তখন আমরা অমর একুশে হল ও সায়েন্স ফ্যাকাল্টির প্রত্যেকটা হল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে আসি। খেয়াল করলে দেখবেন যে, সেদিন রাতে একটা আইকনিক মিছিল ঢাকাসহ সারাদেশ প্রকম্পিত করেছিল একটি শ্লোগান দিয়ে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ আমরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসি। সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল থেকে মেয়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল থেকেও শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ স্লোগান দিয়ে নেমে আসে।’

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘১৫ জুলাই দুপুর বারোটায় আমরা রাজু ভাস্কর্যে একটি কর্মসূচি দেই। ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি দেয়। তবুও আমরা আমাদের কর্মসূচি পরিবর্তন করিনি। রাজু ভাস্কর্য থেকে আমরা যখন হলের দিকে প্রতিদিনকার মতো মিছিল নিয়ে আসতে থাকি, তখনই বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ নৃশংসভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এই সময়ে আমরা দেখি যে তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলন দমন করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করে। তারা নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করে। আমিও এই আক্রমণের শিকার হই। ওরা আমাকেও বেধড়ক পিটায়। রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শাকিরুল ইসলাম শাকিল আমাকে বাজেভাবে পিটিয়ে আহত করে। আমার বাঁ পায়ে জখম হয়। সেদিন আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করা হয়। নারী শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার এই ফুটেজ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে।’

তিনি বলেন, এখানে বলে রাখি, ৯ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আগে সর্বপ্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা তখন শাহবাগে ছিলাম। শাহবাগে আন্দোলন চলাকালীন আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ছিলো। তখন টিএসসিতে ওই কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। শাহবাগ থানার পুলিশসহ অন্যান্য জোনের পুলিশও ছিলো সেখানে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের মোটিভ কী? আমরা বারবার বলেছি, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা নিরসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। পুলিশ থেকে আমাদের ওপর প্রেশার দিতে থাকে আমরা যেন আন্দোলন তুলে নিই। কিন্তু আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের পক্ষে আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ছাত্রলীগ মনে করেছিল ১৫ জুলাইয়ে হামলা করেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু ১৬ জুলাই আরও বেশি শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সবাই একত্রিত হওয়ার পর আমরা একটা বিক্ষোভ মিছিল করি।’

১৬ জুলাই দুপুরে আমরা একটি অনলাইন মিটিং করছিলাম। মিটিংয়ে আমি, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, বাকের, হাসিব থেকে শুরু করে অন্যরাও উপস্থিত ছিল। এসময় খবর পাই যে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমরা ওই মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নিই আর কোনো সংলাপ হবে না। ‘রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়’।

তিনি বলেন, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভিসি চত্বরে একটি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শিক্ষার্থী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সবাই উপস্থিত হন। হাসনাত বলেন, ‘আমার মনে আছে, গায়েবানা জানাজা চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদেরকে কনস্ট্যান্টলি ফোর্স করতে থাকে যেন আমরা গায়েবানা জানাজা না করি। কিন্তু সকল প্রেশার উপেক্ষা করে আমরা গায়েবানা জানাজা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিই। গায়েবানা জানাজা শেষ করে আমরা যখন কফিন কাঁধে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাই, তখনই আমাদেরকে দুই দিক থেকে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। আমাদের ওপর টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলেও আমরা সেটি প্রতিহত করি।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন আপনারা দেখেছেন যে পুলিশকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় এবং বিকাল পাঁচটার মধ্যে হলগুলো খালি করার ক্ষেত্রে প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি গণভবনের প্রেসক্রিপশনে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেন। বিশেষ করে ভিসি এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি আমাদেরকে বারবার ফোর্স করেন আমরা যেন আন্দোলনকে প্রত্যাহার করে নিই। আন্দোলন প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে আমরা বারবার বলি যে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট লাগবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার করতে হবে। আমরা বলি যে, এখন আর এই আন্দোলন থেকে ফেরার পথ নেই। আমরা ভিসির কাছে দাবি জানাই, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

‘হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা কীভাবে কী করব তা নিয়ে সন্দিহান অবস্থায় থাকি। তখন আমি সায়েন্স ল্যাবে আমার মামার বাসায় চলে যাই। তখন আমরা সবাই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাই। তখন আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারজিস আলমও আমার মামার বাসায় চলে আসে। তখন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এরমধ্যে আমাদেরকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল) সংলাপের প্রস্তাব দেন।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সাইন্সল্যাবে আমাদের বাসার নিচে আসে এবং আমাদেরকে বলে, মিটিং করার জন্য একটা জায়গায় আমাদেরকে যেতে হবে। তখন আমরা অনীহা প্রকাশ করে বলি, কোনোভাবেই আমরা এই মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারব না। যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমাদের সবার সমন্বিত সিদ্ধান্ত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা কোনো মিটিং করা সম্ভব না। তখন তারা আমাদেরকে বলে, হয় মিটিংয়ে যাবেন, না হয় বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তারা আমাদেরকে নিয়ে পদ্মাতে যায়।’

‘আমাদেরকে পদ্মাতে নিয়ে যাওয়ার পরপরই সেখানে তিন মন্ত্রী প্রবেশ করেন। তারা হলেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তারা প্রবেশ করার পরেই আমাদেরকে বলেন, আমরা যেন তাদের সঙ্গে মিটিং করি। তখন আমরা প্রত্যাখ্যান করি যে, ওনাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং করা সম্ভব না। বারবার আমাদেরকে পুশ করা হয় আমরা যেন ওনাদের সঙ্গে বসি। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই ওনাদের সঙ্গে মিটিং করতে রাজি হইনি। চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর তিন মন্ত্রী আমাদের সামনেই বের হয়ে চলে যান। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদেরকে সাইন্সল্যাবে না নিয়ে একটি সেইফ হোমে নিয়ে রাখে।’

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, রাত। পরের দিন শুক্রবার। আমাদেরকে জুমার নামাজ পড়তে দেওয়া হয় নাই। তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করায় আমাদেরকে সারারাত ইন্ডিভিজুয়ালি (পৃথকভাবে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাকে একবার, সারজিসকে একবার, এভাবে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। তারা আমাকে বলে, সারজিস রাজি হয়ে গেছে। সারজিসকে বলে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলা হয়, যেহেতু আমার বাবা একসময় বিদেশে থাকতেন। নানানভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো টেনে এনে আমাকে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হতে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাকে কিচেন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন বুঝতে পারি আমি কাকরাইল মসজিদ থেকে বেশি দূরে না। কারণ ওইদিন জুমার নামাজের পরপরই কাকরাইল মসজিদ থেকে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন এই মিছিলটাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এই মিছিলটা সম্ভবত বায়তুল মোকাররমের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। জুমার নামাজের পরে আরেকটা টিম আমাদের কাছে আসে এবং তারা আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়। আন্দোলনের সময়ে তখন সর্বপ্রথম আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রথম লাঞ্ছনার শিকার হই। আমাকে কিচেনে একপর্যায়ে থাপ্পড় দেওয়া হয়। আমাকে বলে যে আমার পরিবার তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। যেন নাহিদসহ আরও যারা আন্দোলনকারী আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা যেন মিটিং করি।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে প্রেস কনফারেন্সের দিনও প্রেশার দেওয়া হয় এটা বলার জন্য যে, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তখন আমরা দেখতে পাই, আমাদের সামনে সাংবাদিকের চেয়েও বেশি আছে এজেন্সির লোকজন। তারা সবাই মোবাইল ও ক্যামেরা হাতে ছিল। আরেকটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিল যে ক্যাম্পাসের শ্যাডোতে, মল চত্বরে, কলা ভবনের সামনে, লাইব্রেরির সামনে আমরা যাদেরকে দেখে ভাবতাম হলের কর্মচারী বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করে, আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা খেয়াল করি যে, ওরা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার (ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির) ফিল্ড স্টাফ।’

তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন আমাদেরকে প্রেশার দেয়, আমরা যেন মিটিং করি। তারপর থেকে আমি আমার স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেই। একটা বাটন ফোন ব্যবহার করা শুরু করি। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির প্রেস কনফারেন্সের পরে আমি মামার বাসায় না গিয়ে কাঁটাবনে আমার বন্ধুর সঙ্গে থাকি। ওইদিন রাতেই আমি আবার মামার বাসায় চলে আসি। সারজিসকেও সেখানে আসতে বলি। নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা এসে সাইন্সল্যাবের বাসা থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর তারা আমাদেরকে গাড়িতে সারা ঢাকা ঘোরায়। তারপর আমাদেরকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’

হাসনাত বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসের প্যাটার্ন ছিল এই টাইপের একটা জায়গায় ত্রিশ জনের মতো অফিস করে। বাথরুম হচ্ছে একটা। সারাদিন আমাদেরকে বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। বসার জায়গা নাই, শোয়ার জায়গা নাই, কমপ্লিটলি ওই অফিসে পেপার-পত্রিকা সব বন্ধ, মোবাইল বন্ধ, টিভি বন্ধ। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য আমার সঙ্গে খুবই রূঢ় আচরণ করে। সে খাবারে সমস্যা করেছে এবং সারারাত বাথরুমের সামনে বসিয়ে রাখত। নিরাপত্তা হেফাজত থেকে একদিন আমাদের গার্ডিয়ানদের আসতে বলা হয়। আমার এক ভগ্নিপতি আসেন আমাকে নেওয়ার জন্য। ওনাকে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বলেন, আপনি চলে যান। কোনো ডিসিশন হয় নাই।’

হাসনাত জানান, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নিয়োজিত ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই আমাকে কল দিয়ে বলেন, ‘কালকে তোরা সামনে থাকিস না। দুইটা শার্ট নিয়ে বের হইস। কারণ আমাদের কাছে নির্দেশ আছে আমাদেরকে গুলি চালাতে হবে’। উনি এই কথাটা বলে অঝোরে কান্না করা শুরু করেন। আমি তখন খুব ইমোশনাল হয়ে যাই। তাকে বলি, ভাই আমরা আসলে পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে আছি। ৫ আগস্ট ফজরের সময় আমাকে তিনি বলছিলেন, আমরা যেন ফার্স্ট লাইনে না থাকি।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট সকালে বৃষ্টি হয়। সারজিস আলমকে মহাখালী থেকে পিক করার কথা ছিল আমার। আসিফ মাহমুদ পুরান ঢাকার ওইদিকে থাকেন। আমি সারজিসকে বলেছিলাম যদি বৃষ্টি হয় তাহলে হয়তো শেখ হাসিনা বেঁচে যাবে। কারণ এটা সংশয় ছিল যে, বৃষ্টি হলে রাস্তায় মানুষ নামবে না। এটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে এবং পুরো আন্দোলন চলাকালীন এই সময়টায় আমি খুব ডিসহার্টেনড (হতাশ) হই। তখন আমি সাকিবকে ফোন দেই। ওরা একেবারে ছোট ছোট। থার্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র। ওরা ২ আগস্ট থেকেই ক্যাম্পাসে এসে শেখ হাসিনার পতনের স্লোগান দেয়। তখন সাকিব আমাকে বলে, ভাই আপনি আসেন। আমরা বের হবো। বৃষ্টি হোক আর যাই হোক, আমরা বের হবো। তখন সাকিব, রিয়াদ, জামিল আসে। আমিও বের হই। আমি আর আগাতে পারি না। গাড়ি নিয়ে আমরা অনেক ঘুরে বিজয় সরণির ওদিকে যাই। ঢাকায় একদম সুনসান নীরবতা। ওই এলাকায় একটা মানুষও ছিল না। মহাখালী ব্রিজটার ওদিকে এসে আবার আমরা টার্ন নেই। কারণ আমরা সাহস পাচ্ছিলাম না যে পেছনে যাব। কারণ কেউই নাই। তখন আমরা এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়া শুরু করি। মহাখালী থেকে তিতুমীরের দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ ছিল। তখন গাড়ি টার্ন নিতে পারে নাই। আমরা সোজা গিয়ে বনানী থেকে টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সেটিও বন্ধ ছিল। তখন নেভির ওদিকে একটা রাস্তা আছে সেটি দিয়ে মহাখালীর দিকে আসতে আসতে ওখানে দাঁড়াই অনেকক্ষণ।’

তিনি বলেন, ‘তখন দুই ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। তখন আমি ভাবি যে ‘উই আর ডান’। কিন্তু একটু পর আবার যখন ইন্টারনেট কাজ করা শুরু করে তখন আমরা নিউজ পেলাম সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবেন। তখন সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে মানুষ বের হওয়া শুরু করল। এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী পর্যন্ত জনস্রোতটা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়েছে। সব দিক থেকে মানুষ আসা শুরু করছে। তখন আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। আর তখন তো মানুষ আর মানুষ। এরপর আমরা গণভবনের দিকে আসলাম। খবর ছড়িয়ে পড়ল স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সারা বাংলায় বিজয়ের মিছিল শুরু হলো। দেশ মুক্ত হলো দেড় দশকের নিপীড়ন নির্যাতন গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারের হাত থেকে। এভাবেই সৃষ্টি হলো নতুন এক বাংলাদেশের, ছাত্র-জনতার বিজয়ের গৌরবগাথা...’

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, আহত ১০ Jul 02, 2025
img
ইসরায়েলে ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা Jul 02, 2025
img
টাই ব্রেকিং ভোটে পাস হলো ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ Jul 02, 2025
img
৯ কোটি টাকা অনুদান পাচ্ছে ৩২ সিনেমা Jul 02, 2025
img
কলকাতায় নিজের জন্মদিন কীভাবে কাটালেন জয়া আহসান Jul 02, 2025
img
জুলাইয়ে এজবাস্টনে মুখোমুখি হবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান Jul 02, 2025
img
জামায়াতের সঙ্গে জোট ও পিআরে নুরের একমত প্রকাশ Jul 02, 2025
img
এই দিন ভুলব না কখনো : নিলা ইসরাফিল Jul 02, 2025
img
‘প্রেমে ব্যর্থ হলে বাথরুম পরিষ্কার করি’ Jul 02, 2025
img
মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার বরখাস্ত Jul 02, 2025
img
রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের রেকর্ড নিয়ে নতুন অর্থবছরের যাত্রা Jul 02, 2025
img
পদযাত্রার মাধ্যমে এনসিপি ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র তৈরি করবে : নাহিদ ইসলাম Jul 02, 2025
img
‘জীবনে প্রত্যেকটা হারের হিসেব রাখে না স্কোরবোর্ড’, গোপন গল্পে নতুন ভূমিকায় ধাওয়ান Jul 02, 2025
img
সাংবাদিক বাংলায় প্রশ্ন করতেই আটকালেন প্রসেনজিৎ! অনুবাদ করে সামলালেন রাজকুমার রাও Jul 02, 2025
img
আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় চিন্ময়সহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল Jul 02, 2025
img
এনসিপি জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে সংসদে কথা বলবে : সারজিস Jul 02, 2025
img
রংপুর-৪ আসনে এনসিপির প্রার্থী হিসেবে আখতারের নাম ঘোষণা Jul 01, 2025
img
যারা প্রোফাইল লাল করেছিল তাদের জীবন লাল করে দেবে আ. লীগ : পার্থ Jul 01, 2025
img
ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর পতন সন্নিকটে : ইরানি জেনারেল Jul 01, 2025
img
পুলিশের হাতে গ্রেফতার অভিনেত্রী মিনু মুনির Jul 01, 2025