আলিফ লায়লা... সেই নামটি শুনলেই যেন ছোটবেলার পর্দায় ভেসে ওঠে জ্বীন, পরী, উড়ন্ত কার্পেটের জাদুর জগৎ। নব্বইয়ের দশকের শুক্রবারের সন্ধ্যা বা রাতে পরিবারের সবাই মিলে বিটিভির সামনে বসে সেই রহস্যময় গল্পগুলো দেখার স্মৃতি আজও অনেকের মনে রঙিন হয়ে আছে। বিশেষ করে সেই বিখ্যাত শুরুর সুর – যা শুনলেই মনে হতো, এ যেন কোনো মায়াবী দেশে হারিয়ে যাওয়া। চোখ রাখলেই যাদু, চোখ ফেরালেই ভয় যে কিছু মিস হয়ে যাবে!
আরব্য রজনীর কাহিনীর ছায়ায় নির্মিত এই ধারাবাহিক শিশু থেকে বড় সবাইকে বুঁদ করে রাখত। গল্পের পর গল্পে আমরা হারিয়ে যেতাম অন্য কোনো ভূখণ্ডে। কখনো রাজপ্রাসাদ, কখনো জ্বীনের আস্তানা, আবার কখনো সমুদ্রযাত্রার গল্প। আর এসব গল্পের শুরুই হতো পারস্যের সম্রাট শাহরিয়ার আর উজিরকন্যা শাহরাজাদের সেই ভয়াল অথচ রোমাঞ্চকর গল্পে— যেখানে মৃত্যুর মুখ থেকে রেহাই পেত শুধু গল্প বলার জাদুতে।
সম্রাট শাহরিয়ার ছিলেন এমনই এক রক্তপিপাসু শাসক যিনি প্রতিটি কুমারী স্ত্রীকে বাসররাতের পর পরদিন সকালে মৃত্যুদণ্ড দিতেন। শাহরাজাদ নিজের জীবনের বিনিময়ে রাজার এই নারীবিদ্বেষ থামাতে শুরু করেন অশেষ গল্প বলা, যা ১০০১ রাত পর্যন্ত গড়ায়। সেই সব গল্পে আমরা পাই আলাদিন, আলিবাবা, জ্বীন, পরীর পাশাপাশি পাই এক নাবিকের গল্প— যে হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় চরিত্র।
সেই নাবিক সিন্দাবাদ। যিনি ছিলেন বাগদাদের বিখ্যাত সওদাগর, সাহসী আর আল্লাহভীরু এক মানুষ। সাতবার সমুদ্রযাত্রায় গেছেন, প্রতিবারই পড়েছেন ভয়ংকর বিপদে— কখনো ঝড়ে জাহাজ ভেঙেছে, কখনো দৈত্যের কবলে পড়েছেন, কখনো দ্বীপ ভেবে নেমেছেন তিমির পিঠে, আবার কখনো রক-পাখির সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু তার সততা, সাহস আর আল্লাহর ওপর অগাধ আস্থা তাকে বারবার বাঁচিয়ে তুলেছে। বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করেছেন, উপকার করেছেন অজস্র মানুষের। এই চরিত্র হয়ে উঠেছিল দয়ার সাগর আর সত্যিকারের বীরের প্রতীক।
নব্বইয়ের সেই টেলিভিশন পর্দায় এই চরিত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন অভিনেতা শাহনেওয়াজ প্রধান। তাঁর অভিনয়ে সিন্দাবাদ শুধু এক রূপকথার চরিত্র নয়, হয়ে উঠেছিল বাঙালি দর্শকের জীবন্ত স্মৃতি। বিটিভির পর্দায় শাহনেওয়াজ প্রধানের সিন্দাবাদ মানেই ছিল এক রোমাঞ্চকর যাত্রা।
আলিফ লায়লা ছিল ভারতীয় নির্মাণ। এই ধারাবাহিকটি ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রায় এক দশক ধরে প্রচারিত হয়। শাহনেওয়াজ প্রধান ছাড়াও এই ধারাবাহিকে ছিলেন আরও অনেক জনপ্রিয় মুখ। তবে সিন্দাবাদের চরিত্রে তার অভিনয়ই হয়ে যায় মানুষের মনে স্থায়ী।
শাহনেওয়াজ প্রধান পরবর্তীতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তার সিন্দাবাদ চরিত্র আজও বেঁচে আছে দর্শকের মনে। শুক্রবারের সেই সন্ধ্যা, টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে চোখের পলক না ফেলার অভিজ্ঞতা, আর সিন্দাবাদের দুঃসাহসিক অভিযান— সবই রয়ে গেছে নস্টালজিয়ার অমূল্য ঝুলিতে।
এখনো যখন আলিফ লায়লার নাম আসে, তখন সবার আগে মনে পড়ে সেই নাবিকের গল্প, যে বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে শুধু বিশ্বাস আর সাহস নিয়ে। শাহনেওয়াজ প্রধানের সিন্দাবাদ হয়ে উঠেছিল তাই শুধু ছোটদের নয়, সব বয়সী দর্শকের প্রিয় নায়ক।
এফপি/ টিএ