ফিদেল কাস্ত্রো : এক বিপ্লবী মহানায়ক

ফিদেল কাস্ত্রো। কিউবার বিপ্লবী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অর্থনীতির কঠোর সমর্থক। মার্কিন পুঁজিবাদের ঘোর বিরোধী।

কিউবায় ঐতিহাসিক কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রো। যা দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

শিক্ষা, সামাজিক মুল্যবোধ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তার অবদান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

তবে তার শাসনামলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিপীড়ন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দার জন্য অনেকে কিউবা দেশ পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্যে অনেকে তার সমালোচনা করেছেন।

১৯২৫ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার অরিয়েন্ট প্রদেশের বিরেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো।

১৯৪৫ সালে তিনি কিউবার হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হন। এ সময় তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সামরিক নেতা বাতিস্তার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন জান্তা সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি সাম্যবাদী বামপন্থী দল “পার্টি অফ দ্য কিউবান পিপল” এ যোগ দেন। এ দলটি কিউবার জান্তা সরকারের ঘোর বিরোধী ছিল এবং উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

পড়াশোনা শেষ করে তিনি ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র এবং কলাম্বিয়ায় সরকারবিরোধী বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন।

ভ্রমণকালে তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।

কিউবার জান্তা সরকারের বিরোধীদের উৎসাহ দিতে ১৯৫২ সালে তিনি “ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে” শীর্ষক ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ৫টি প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেন।

এগুলো হলো- ১৯৪০ সালের কিউবার সংবিধান পুনর্বহাল, ভূমি অধিকার আইনের সংস্কার, কোম্পানির মুনাফার ৩০ শতাংশ শিল্প শ্রমিকদের প্রদান, চিনি শিল্প শ্রমিকদের কোম্পানির মুনাফার ৫৫ শতাংশ প্রদান এবং পূর্ববর্তী প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ।

এরপর ডানপন্থী বাতিস্তার নেতৃত্বাধীন কিউবার জান্তা সরকারকে উৎখাত করতে তিনি ১৯৫৩ সালে মোনকাদা ব্যারাকে আক্রমণ করেন। কিন্তু তার আক্রমণ ব্যর্থ হয় এবং তিনি ধরা পড়ে যান। বিদ্রোহের অভিযোগে এক বছর কারাবরণ করেন তিনি।

কারাগারে থাকাকালে মার্কসবাদ চর্চার লক্ষ্যে “২৬ জুলাই আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করেন।

মুক্তির পর তিনি মেক্সিকো চলে যান। সেখানে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ প্রতিষ্ঠায় লড়াইরত আরেক বিপ্লবী চে-গুয়েরার সাথে যোগ দেন। এখান থেকেই তিনি কিউবার বিদ্রোহীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দিতে থাকেন।

ধীরে ধীরে কিউবায় বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৫৯ সালে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে পতন হয় বাতিস্তা সরকারের। ফিদেল কাস্ত্রো নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

একটি পূর্নাঙ্গ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার করেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজসেবা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করেন।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভূমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন। দুই লক্ষ কৃষককে ভূমির মালিকানা প্রদান করেন।

গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি নির্বাচন দেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন তার প্রতি কিউবান জনগণের সমর্থন রয়েছে। তবে তিনি সকল প্রকার বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে দেন এবং সরকার বিরোধীদের গ্রেফতার করেন।

১৯৫৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তবে কিছুদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি কিউবায় মার্কিন কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে কঠোরতা আরোপ করেন।

এতে আমেরিকাও কিউবার উপর বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে কাস্ত্রো সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গভীর করেন।

সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে কিউবার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। তাই কিউবায় ব্যাপক অর্থনৈতিক সাহায্য দেয় রাশিয়া। আর কাস্ত্রো সমাজতন্ত্রের কট্টর সমর্থক হয়ে ওঠেন।

কাস্ত্রো বলতেন, “জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ লালন করে যাবো”।

কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবেশী দেশ কিউবার এমন উত্থানে ভীত হয়ে ওঠে আমেরিকা। তাই একের পর এক কিউবার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। কিউবায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় ফিদেল কাস্ত্রো জনগণের কাছে ছিলেন এক মহানায়ক।

১৯৬২ সালে কাস্ত্রোর নির্দেশে কিউবার মার্কিন সীমান্তের নিকটবর্তী সীমানায় অস্ত্র মোতায়েন করে রাশিয়া। এতে ভয়াবহ সামরিক সংকট দেখা দেয় যা “মিসাইল সংকট” নামে পরিচিত।

জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের প্রচেষ্টায় আরেকটি বিশ্ব যুদ্ধ থেকে বেঁচে যায় বিশ্ব।

কাস্ত্রো বিশ্বব্যাপী বিপ্লব-সংগ্রাম ছড়িয়ে দিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে অ্যাঙ্গোলা, লিবিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিল্পবীদের সমর্থন দিতে কিউবান সেনা পাঠিয়েছেন।

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট প্রশ্নে তিনি সবসময় ফিলস্তিনের পক্ষে ছিলেন।

১৯৮০ সালে কিউবায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে তার জনপ্রিয়তা কমে যায়।

১৯৯০’র দশকে কিউবা এবং বৈশ্বিক পরিবেশ উন্নয়নে বেশ কিছু সফল উদ্যোগ নেন কাস্ত্রো।

কাস্ত্রো নিজেকে একজন নাস্তিক দাবী করেন এবং খ্রীষ্টান ধর্মের বৈষম্যের সমালোচনা করেন।

২০০৮ সালে স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা দিয়ে অবসরে যান কাস্ত্রো। রাষ্ট্র ক্ষমতায় না থাকলেও কিউবায় তার প্রভাব কমেনি।

অবশেষে ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর মারা যান ইতিহাসের এই বিপ্লবী মহানায়ক।

পশ্চিমাদের দ্বারা সমালোচিত হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় নেতা।

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে নতুন রেকর্ড Dec 22, 2025
img
আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক Dec 22, 2025
img
কৃষি ও সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রভিশন শিথিল করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক Dec 22, 2025
img
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সব হিমবাহ হারাতে পারে ভেনেজুয়েলা Dec 22, 2025
img
ঘন কুয়াশায় শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ Dec 22, 2025
img
নিরাপত্তা জনিত কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা রাবি শিক্ষকের Dec 22, 2025
img
২ দফা না মানায় কর্মসূচি নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের সংবাদ সম্মেলন আজ Dec 22, 2025
img
ফরিদপুরে ৭ বিএনপি নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার Dec 22, 2025
img
ফেনীর তিনটি সংসদীয় আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিলেন ২ জন করে প্রার্থী Dec 22, 2025
img
মাধুরীর ‘এক দো তিন’ অন্যতম আইকনিক নৃত্য সংগীত Dec 22, 2025
img
২২ ডিসেম্বর: বছরের সবচেয়ে ছোট দিন আজ Dec 22, 2025
img
পয়েন্ট টেবিলে রিয়ালের সঙ্গে বড় ব্যবধান রেখে বছর শেষ বার্সার Dec 22, 2025
img
ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে বরখাস্ত করতে বললেন জেফ বয়কট Dec 22, 2025
img
দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার অবস্থান ২য় Dec 22, 2025
img

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর

৫ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি Dec 22, 2025
img
আজকের আবহাওয়া : রাজধানী ঢাকার আকাশ মেঘলা থাকতে পারে Dec 22, 2025
img
কমিশন নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য ছড়ানো হচ্ছে : গুম কমিশন Dec 22, 2025
img
২২ ডিসেম্বর: ইতিহাসে এই দিনটিও গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় Dec 22, 2025
img
অপরাধী গ্রেপ্তার না হওয়ায় রহুল কবির রিজভীর ক্ষোভ প্রকাশ Dec 22, 2025
img
দেশের বাজারে আজ কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ Dec 22, 2025