নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে চালু হওয়ার তিন মাসে ৩ রোহিঙ্গা আটক

নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র তিন মাস আগে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় দগ্ধ হওয়া এই কার্যালয়টি নতুনভাবে চালু হয় চলতি বছরের ৪ মে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জেলার মানুষ স্বস্তি পেলেও দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক- মাত্র তিন মাসেই এখানে ধরা পড়েছে অন্তত তিন রোহিঙ্গা নাগরিক।

সবশেষ গত ১৮ আগস্ট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে আটক হয় মো. আরিয়ান নামের এক যুবক। পরে জানা যায়, তার আসল নাম মো. আনোস। তিনি কক্সবাজারের উখিয়া থানার ২৬নং লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ে তার নাম রোহিঙ্গা ডাটাবেজে মিলে যায়। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে পাসপোর্ট করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

এর আগে ৩ জুন আটক হয় সুমা আক্তার নামের এক নারী। তিনি জন্মস্থান ঢাকার কেরানীগঞ্জ দেখিয়ে বাবা-মা ও স্বামীর নামসহ পূর্ণ কাগজপত্র জমা দেন। বাবা, মা ও স্বামীরও আলাদা এনআইডি ছিল। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, সবগুলোই জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি। অর্থাৎ একটি গোটা পরিবারকে দালালচক্র বাংলাদেশি নাগরিক বানিয়ে ফেলেছিল।

২৫ মে একই অফিস থেকে আটক হয় কিশোর আব্দুল আজিজ। বয়স আড়াল করে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন তিনি। সঙ্গে জমা দেন জন্মনিবন্ধন ও মা-বাবার এনআইডি। কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায়, সবকটি কাগজপত্রই জাল। তার আসল বয়স আঠারো বছরের নিচে এবং তিনি রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। শুধু সে নয়, তার মা–বাবারও ভুয়া এনআইডি ছিল।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে, আটক তিনজনই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ সংগ্রহ করেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর জোন এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন থেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনটি ঘটনাতেই একই ধারা দেখা যায়, প্রথমে দালালচক্র ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করছে, এরপর নির্বাচন অফিস থেকে এনআইডি করাচ্ছে, তারপর পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে। শেষ ধাপে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ে ধরা পড়লেও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আগের ধাপগুলো সহজেই পার হয়ে যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক শামীম আহমদ বলেন, “অফিস চালুর পর থেকেই আমরা ভুয়া কাগজপত্র পাচ্ছি। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভুয়া জন্মনিবন্ধন বা এনআইডি নিয়ে আসে। তবে মাত্র তিন মাসে তিনজন রোহিঙ্গা ধরা পড়া সত্যিই উদ্বেগজনক। এর মানে হচ্ছে, এর পেছনে বড় ধরনের দালালচক্র কাজ করছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই দালালচক্রগুলো সাধারণ প্রতারক নয়, তারা প্রযুক্তি জানে এবং প্রশাসনিক দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে। আমরা এখন প্রতিটি কাগজপত্র ডাটাবেজ মিলিয়ে যাচাই করছি এবং বায়োমেট্রিক যাচাই বাধ্যতামূলক করেছি। তবুও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ ও নির্বাচন অফিস থেকে ভুয়া এনআইডি তৈরি হয়ে আসায় সমস্যাটা থেকে যাচ্ছে।”

তার মতে, মূল জায়গায় কড়াকড়ি না হলে ঝুঁকি বাড়বে। পাসপোর্ট অফিসে আমরা শেষ ধাপে যাচাই করি। কিন্তু যদি শুরুতেই ভুয়া জন্মসনদ ও এনআইডি তৈরি হয়ে যায়, তবে অনেকেই ফাঁক গলে যাবে। তাই ইউনিয়ন পরিষদ ও নির্বাচন অফিসেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “রোহিঙ্গারা যদি এনআইডি ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে থাকে, তবে এটা শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

স্থানীয়দের অভিযোগ, একজন রোহিঙ্গা যদি সহজেই এনআইডি সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে নির্বাচন অফিসের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল হক পাটোয়ারী বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় একজন বাংলাদেশি নাগরিককে এনআইডি করতে হয়, সেখানে রোহিঙ্গারা কীভাবে পাচ্ছে? এটা কেবল অসতর্কতা নয়, ভেতরে নিশ্চয়ই যোগসাজশ আছে।”

জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পেয়ে গেলে রোহিঙ্গারা জমিজমা কেনাবেচা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, মোবাইল সিম নেওয়া সবকিছুই করতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়, তারা পাসপোর্ট করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করতে পারে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি মানবপাচার ও মাদকচক্রও আরও শক্তিশালী হতে পারে।

ইসির অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ ও জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেসের মধ্যে এখনও কার্যকর সমন্বয় হয়নি। ফলে ভিন্ন তথ্য দিয়ে অনেকে ফাঁক গলে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “ভুয়া জন্মসনদ বানানো সবচেয়ে সহজ ধাপ। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া সনদ নিয়ে এলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা যাচাই না করেই এন্ট্রি দেন। এখানেই বড় সমস্যা।”

এফপি/ টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ট্রাম্পের ক্ষমার পর হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্টের মুক্তি Dec 02, 2025
img
পরীক্ষা না নিলে শিক্ষকরা শাস্তির মুখে পড়বেন: শিক্ষা উপদেষ্টা Dec 02, 2025
img
খালেদা জিয়ার এই পরিণতির জন্য শেখ হাসিনা দায়ী : রিপন Dec 02, 2025
img
যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেনা সদস্যদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে: সেনাপ্রধান Dec 02, 2025
img
ভোটকে বিলম্বিত করতে কয়েকটি দল ষড়যন্ত্র করছে: সালাহউদ্দিন আহমদ Dec 02, 2025
img
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে তিন বাহিনী প্রধান Dec 02, 2025
img
আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে ওমরাহ যাত্রীদের তথ্য চাইল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় Dec 02, 2025
img
প্রকাশিত হলো বিপিএলের চূড়ান্ত সূচি Dec 02, 2025
img
সরকারি বাসভবন থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন কুকুরছানা ঘটনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তা Dec 02, 2025
img
টলিপাড়ায় ফের নীল-তৃণার দাম্পত্যে ফাটলের গুঞ্জন Dec 02, 2025
img
তারেক রহমানের ফেরা নিয়ে অনেকে অতিআগ্রহী, এত আলোচনার প্রয়োজন নেই: আমীর খসরু Dec 02, 2025
img
টেকসই সামুদ্রিক ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা Dec 02, 2025
img
কেবিসির মঞ্চে অমিতাভের সাথে নাচলেন হারমানপ্রীতরা Dec 02, 2025
img
শেষদিকে গোল হজম করে হারলো বাংলাদেশ Dec 02, 2025
img
ঘোমটা দিয়ে ঢাকতে হবে মাথা, বিয়ের আগেই স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন রনদীপ Dec 02, 2025
img
দেশের বাজারে কমানো হলো স্বর্ণের দাম Dec 02, 2025
img
মুজিববাদ ও মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-এনসিপির ঐক্য চান পাটোয়ারী Dec 02, 2025
img
ধূমপানমুক্ত দেশ গড়ার ইতিহাসের অপেক্ষায় সুইডেন Dec 02, 2025
img
সামান্থা-রাজের আধ্যাত্মিক বিবাহ, ভীষণ আড়ম্বরহীন! Dec 02, 2025
img
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস সিইসির Dec 02, 2025